ঢাকা: বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এসেছি, বঙ্গবন্ধু তখন গেঞ্জি গায়ে দোতলা থেকে নেমে এলেন। নিজ হাতে গাড়ির দরজা খুলে আমার স্ত্রীকে তুলে দিলেন।
আমি তখন বঙ্গবন্ধুর (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) ব্যক্তিগত সহকারি ছিলাম। আবেগে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। কোনো প্রধানমন্ত্রী তার স্টাফকে এভাবে বিদায় জানিয়েছেন, সারা দুনিয়াজুড়ে এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. মসিউর রহমান। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালনের স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি। ড. মসিউর রহমান বলেন, তার সঙ্গে কাজ করার সময় কখনও মনে হয়নি আমি বেতনভোগী কর্মচারী আর তিনি প্রধানমন্ত্রী। দুপুরে কোনো কাজের জন্য গেলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন খেয়েছি কিনা। হয়তো খাইনি, কিন্তু বিষয়টি এড়াতে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথাই আমরা বলতাম। কিন্তু তিনি ঠিক ধরে ফেলতেন। বলতেন, ‘এসো খাও আগে, পরে কথা হবে। ’
খেতে বসেছি, বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে মাছের টুকরো পাতে তুলে দিতেন। কোন মাছ কেমন করে খেতে হয় তাও শিখিয়ে দিতেন। ঠিক কেউ বাবার সঙ্গে খেতে বসলে বাবা সন্তানকে যেভাবে ভুল ধরিয়ে দেন। তেমন দৃশ্যের অবতারণা হতো।
প্রধানমন্ত্রী-কার্যালয়ে জহুরুল হক নামের একজন উপ-পরিচালক (যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার) ছিলেন। তাঁকে জহুর ভাই বলে ডাকতেন বঙ্গবন্ধু। এই লোকটি যখনই বঙ্গবন্ধুর রুমে যেতেন বঙ্গব্ন্ধু চেয়ার ছেড়ে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াতেন। আমরা খুবই অবাক হতাম প্রধানমন্ত্রীর শেখ মুজিবুর রহমানের এমন বিস্ময়কর সৌজন্যবোধ দেখে।
একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর রুমে গেলে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান করা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হতো। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতাম না। একদিন সাহস করে বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্য ইংরেজির ড্রাফট করতেন জহুর ভাই। একমাত্র তাঁর ড্রাফটেই হাত দিতেন না। আর যারাই ড্রাফট করে নিয়ে যেতেন সংশোধন করতেন সোহরাওয়ার্দী।
কিছু লোক আছেন যারা শেখ কামাল সম্পর্কে রসিয়ে রসিয়ে গালগল্প বলতে ভালোবাসেন। কিন্তু আমি কাছ থেকে দেখেছি ভিন্ন এক শেখ কামালকে। একবার পশ্চিমবঙ্গে খেলতে যাবে আবাহনী। শিক্ষা ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তখন একত্রে ছিল। মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক সাহায্যের আবেদন করে আবাহনী। শেখ কামাল আমার কাছে এসে তদ্বির করার জন্য অনুরোধ করলেন। আমি যখন ফাইলটি নিয়ে গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রেখে দাও’। আমি শেখ কামালের অনুরোধের কথা তাঁকে জানালে তিনি আবারও বললেন, ‘রেখে দাও। ’ফাইলটি আটকে যাওয়ার পর শেখ কামালও আর কখনই তদ্বির করতে আসেননি। টাকার পরিমাণও কিন্তু খুব বেশি ছিল না। মাথাপিছু মনে হয় ৫ ডলারের মতো ছিল। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের হলে হয়তো এমনিতেই দেওয়া হতো। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু হয়তো চাননি তার পরিবারের লোকজন কোনো সুবিধা পাক। সে কারণে ফাইলটি আর কখনই ছাড় করা হয়নি।
বেগম মুজিব ছিলেন আরও একধাপ এগিয়ে। তিনি কখনই সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা নিতেন না। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়া সফরে ছিলেন। বেগম মুজিব আমাকে ফোন করে বললেন, তার এক আত্মীয় তাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে গোপালগঞ্জ যেতে চান। আমি যেনো তাকে বুঝিয়ে বলি এটা সম্ভব নয়।
জবাবে আমি বেগম মুজিবকে বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে প্রটোকল অনুযায়ী আপনি হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পারেন। পাল্টা উত্তরে জানালেন, সেটা হয়তো রাষ্ট্রীয় সফরে। আমি পারিবারিক কোনো কাজে হেলিকপ্টার ব্যবহার হোক চাই না।
বঙ্গবন্ধু যখন ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন, তখন ড. মসিউর রহমান ছিলেন আমেরিকায়। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে ফেরা-না-ফেরা নিয়ে দোটানায় ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসার শেষ আদেশ বা পরামর্শটি মনে পড়ে যায় তাঁর। আর তখনই দেশে চলে এসেছিলেন মসিউর রহমান।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৭
এসআই/জেএম