দুর্লভ প্রজাতির এই গাছটির গোড়ায় করাত চালানো হয়েছে। হানা হয়েছে উপর্যুপরি কুঠারের আঘাত।
বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা হয়ে সোজা কিছুটা পূর্বে গেলেই ঐতিহাসিক নবাব প্যালেসের দেখা মিলবে। স্থানটি থেকে প্রায় ১ কিলোমিটারের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কার্যালয়। এরপরও কেউ কিছু জানেন না। একজন দেখলেও ঠেকানোর চেষ্টা করেননি।
রোববার (০৯ এপ্রিল) সকালের পর থেকে গাছ কাটার খবরটি ছড়তে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের প্রায় সর্বত্র শতবর্ষী জয়তুন গাছ কেটে ফেলার খবর ছড়িয়ে পড়ে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান গণমাধ্যমকর্মীরা। এসময় উপস্থিত সবাই গাছ কাটার দৃশ্য দেখতে পান। কারা কেন গাছটি কাটছে জানতে চাইলে নবাব প্যালেসের ব্যবস্থাপক বলে দাবিদার জাহেদুল ইসলাম লজে বলেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি এটি। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান মিলন, আলহাজ্ব আব্দুল গফুর ও শফিকুল হাসান জুয়েল ক্রয়সূত্রে এই প্যালেসের মালিক।
জাহেদুল ইসলাম লজে বলেন, তাদের নিয়োজিত ব্যবস্থাপক হিসেবে আমি জয়তুন গাছ কাটার অর্ডার দিয়েছি। আমার অর্ডার মোতাবেক শ্রমিকরা গাছ কাটছে।
‘সম্পত্তি সুরক্ষা ও মালিকদের কর্তৃত্ব প্রমাণের জন্য এই গাছ কাটা হচ্ছে’ বলেও দম্ভোক্তি করেন ব্যবস্থাপক দাবিদার জাহেদুল ইসলাম লজে।
এদিকে সরকারি গেজেটে এই প্যালেসকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে বেশ আগেই। সে অনুযায়ি গাছ কাটার খবরের সত্যতা জানার জন্য প্যালেসের ভেতরে প্রবেশ করেন প্রত্মতত্ত্ব অধিদপতরের ফিল্ড ইন্সপেক্টর হাসিবুল হাসান। তখন তার সামনেই শ্রমিকরা গাছের গোড়ায় করাত চালাচ্ছিলেন। সমানতালে চালাচ্ছিলেন কুঠারও। তিনি এ দৃশ্য শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেন। গাছ কাটা ঠেকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি।
উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের ফিল্ড ইন্সপেক্টর হাসিবুল হাসান বলেন, ‘বনবিভাগ বা পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া এই গাছ কাটার আইনগত কোনো সুযোগই নেই। আমি ঘটনাটি নিজ চোখে দেখলাম। ঘটনাটির পুরো বিবরণ তুলে ধরে আমি কর্তৃপক্ষের কাছে লিখবো। এরপর যা করার তা উর্ধ্বতনরাই করবেন’।
সন্ধ্যায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বাংলানিউজকে জানান, গাছটি কাটার বিষয় তাকে জানানো হয়নি। খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তৌফিক হাসান ময়না বাংলানিউজকে বলেন, ঐতিহাসিক স্থাপনাটি রক্ষায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারিভাবে স্থাপনাটিকে সংরক্ষণের জন্য প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা সেই দায়িত্ব পালন করেনি।
তিনি আরো বলেন, এ কারণে ঐতিহ্যবাহী জয়তুন গাছটি কেটে ফেলা হলো। অথচ আমার জানা মতে, গোটা দেশ মিলে মাত্র ২-৩টি জয়তুন গাছ রয়েছে। তার মধ্যে এটি একটি। এ ঘটনায় প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানো ছাড়া কি-ইবা করার আছে!
প্রসঙ্গত, বৃটিশ আমলে নীলকুঠি হিসেবে নির্মিত এই প্যালেসটি নিলামে ক্রয় করেন বগুড়ার নবাব আব্দুস সোবহান চৌধুরী। ১৮৯২ সালে তৎকালীন বাংলার ছোট লাট চার্লস ইলিয়ট ‘আব্দুস সোবহান চৌধুরীকে’ নবাব খেতাব দেওয়া উপলক্ষে নিজ হাতে রোপন করেছিলেন এই গাছটি।
তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) এই প্যালেসেরই মোতয়াল্লি ছিলেন। তার অবর্তমানে ওয়াকফকৃত এ ঐতিহাসিক নিদর্শনটি তার বৈমাত্রেয় ভাই ওমর আলী চৌধুরী এবং দুই ছেলে সৈয়দ হাম্মাদ আলী ও হামদে আলী বেকারত্ম ও দারিদ্রের কবলে পড়ে বেআইনি প্রক্রিয়ায় এটি দফায় দফায় বিক্রি করে দেন।
পরে এই প্যালেস রক্ষায় বগুড়ায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এরই ধারাবাহিকতায় গেল বছর সরকারিভাবে স্থাপনাটি সংরক্ষণের ঘোষণা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করা হয় সরকারিভাবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৭
এমবিএইচ/জেএম