আহত হয়েছেন যারা, তাদেরও ক্ষত-বিক্ষত শরীর, হাত নেই, পা নেই। করাত দিয়ে কাটা হচ্ছে হাঁটু, যেন নিচের অংশ বাদ দিয়ে হলেও বাঁচানো যায়।
চার বছর পরও সোজা পায়ে হাঁটতে পারেন না অনেকেই। কেউ কেউ নতুন চাকরি পেয়েও হারিয়েছেন। কারণ, শব্দ শুনলে ভয় পান, মাথাব্যথা করে।
ভুলে গেছে বাংলাদেশ! বেশিদিন আগের কথা তো নয়। দেয়ালে মাত্র চারটি ক্যালেন্ডার বদলেছে। এতো রক্ত, বাতাসে মরদেহের গন্ধ, স্বেচ্ছাসেবকদের মৃত্যু, ছেলের মরদেহ খুঁজতে বাবা-মায়ের অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে ঘোরা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঝাঁকুনি তত্ত্ব, এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের নিবেদিত শ্রম, দেশের মানুষের কান্না- এর সবই ভুলে গেছে!
সোমবার (২৪ এপ্রিল) পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম কারখানা ট্রাজেডি, রানা প্লাজা ধসের চার বছর পূর্তি। ঠিক ৪ বছর আগের এই সকালে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো জাতি। ভবনের নিচ থেকে মরদেহ টানা শুরু হয়েছিল। বেঁচে থাকা প্রাণগুলো বাঁচার জন্যে চিৎকার করছিল।
গত কদিন ধরেই, নির্দিষ্টভাবে বললে ৪ দিন ধরেই বাংলানিউজসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে আসছে রানা প্লাজা ট্রাজেডির কথা। কারণ, এ দিনে আবারো মানুষকে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় মিডিয়া।
তবে এ ইস্যু নিয়ে মাঝে মাঝে আদালতের কথা ছাড়া অন্য কোনো রিপোর্ট প্রকাশ পায়নি। কারণ, গণমাধ্যমও তার রিপোর্টের বিক্রি মূল্য বিবেচনা করে রিপোর্ট করছে। আদতে হয়তো, মিডিয়াও দিনটিকে ভুলে যেতে বসেছে, ভুলে যেতে চেয়েছে!
কোনো গণমাধ্যমেই এ কারণে হয়তো গত চারদিনের আগে রানা প্লাজা ট্রাজেডি নিয়ে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বা আহত শ্রমিক বা নিহত শ্রমিকের পরিবারগুলো নিয়ে রিপোর্ট হয়নি।
বেসরকারি সংস্থাগুলো, যারা এ ট্রাজেডিকে নিয়ে নিজেদের প্রকল্প পরিকল্পনা সাজিয়েছে, তারাও এখন সরগরম হয়ে উঠছে।
এ বছরের দিনটিকে কেন্দ্র করে শনিবার (২২ এপ্রিল) ব্র্যাক-ইন সেন্টারে জরিপ প্রকাশ করে আলোচনায় আসে বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড। ঠিক দিবসটির আগে আগে কেন এ জরিপ প্রকাশ? সংশ্লিষ্টরাই বলছেন, তাহলে মিডিয়ার কাভারেজটা ভালো পাওয়া যাবে। মূলত সকলেই দিনটিকে উপলক্ষ করে নিজেদের প্রকল্প সাজায়।
গত কয়েকদিন ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কিছু মানববন্ধন চোখে পড়ছে। যেটি সারা বছর আর হবে না। সোমবার রানা প্লাজার সামনেও মানববন্ধন হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান, নেতা-নেত্রী, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামবে। তারা গলা ফাটাবেন, শ্রমিকদের অধিকারে কথা বলবেন নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো করে। মিডিয়া কাভার করবে।
২৪ এপ্রিলের দিন পার হয়ে রাত নামলে সবাই ফের ভুলে যাবে সব!
এরই মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক আহতদের আজীবন চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা রাখেনি। অভিযোগ জানিয়েছেন আহত ব্যক্তিরা।
ওয়ার্কার্স সেফটি ফোরামের আহ্বায়ক হামিদা হোসেন বলেছেন, শুধু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, বিদেশি অনেক সংস্থাও এসব আহত শ্রমিকদের পুর্নবাসনের কথা বলে কিছু প্রকল্প শুরু করেছিল। সেগুলোর বর্তমান অবস্থাও জানা নেই কারো।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা এদেশকে যা দিতে পারেননি, দিয়েছেন গ্রাম থেকে শহর-উপশহরগুলোতে আসা কিছু তরুণ প্রাণ। সকালের রোদ ধরে মিছিলের মতো তারা হেঁটে ঢোকেন কারখানায়। সারা দুনিয়ার সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের কাপড়ের ট্যাগে লেখা ফুটে ওঠে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। দেশের অর্থনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন তারা।
সেই তরুণদের, নতুন সংসারের স্বামী বা স্ত্রী, সেই সন্তানদের মা-বাবাদের ১ হাজার ১৩৫টি প্রাণ লজ্জা দেয়, ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় আমাদের দিকে। যারা তাদের হত্যার দিনটিতেই শুধু লিখি, হত্যার দিনটিতেই শুধু বলি, হত্যার দিনটিতেই শুধু মানববন্ধন করি। কংক্রিটে চাপা পড়া সেই নিথর মুখটি থেকে থু থু বের হয়ে আসে ভুলে যাওয়াদের দিকে তাক করে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৭
এমএন/এএসআর
** শিউরে ওঠা ২৪ এপ্রিল!