চেনা এমন উপত্যকায় এখন থই থই জলরাশি। আর এর নিচে ডুবে আছে হাওরের শস্যভাণ্ডার।
হাওরের চার মাস ফসলের। বাকি সময়টায় শুধুই পানির দাপট।
তবে পাহাড়ি ঢলে এবার হাওরে পানি এসেছে আগাম। কৃষকদের স্বপ্ন সোনা হয়ে ফলার সময়েই হানা দিয়েছে অকাল দুর্যোগ। বিস্তীর্ণ হাওর অথৈ ঢলে তলিয়ে যাওয়ায় ঘাম ঝরানো শ্রমে ফলানো ফসল কৃষকের ঘরে ওঠেনি, নষ্ট হয়ে গেছে পানির নিচেই।
নিয়তির এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতায় শস্যভাণ্ডার খ্যাত হাওরের মানুষকে হাত পেতে নিতে হচ্ছে সরকারি ত্রাণ সহায়তা। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে সোনার ফসল ফলিয়েও গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে চাল পাওয়ার লাইনে।
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের উত্তর-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ বিলই হাওর নামে পরিচিত। অষ্টগ্রাম ছাড়াও হবিগঞ্জের বানিয়াচং, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগর আর কিশোরগঞ্জের মিঠামইন ও ইটনাজুড়ে এ বিলের অবস্থান।
আর আব্দুল্লাহপুর, আদমপুর ও কালমা ইউনিয়নের কয়েক হাজার হেক্টর জমিই অষ্টগ্রামের শস্যভাণ্ডার।
বছরে একবারই ফসল ফলে অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও ইটনার হাওরে। অগ্রহায়ণে মাইলের পর মাইলজুড়ে ছড়িয়ে থাকে সবুজ ধানের ক্ষেত। সে ধান চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের মাঝভাগে কাটা হয়। তবে এ বছর সবুজ ধান ক্ষেতে সোনালী আভা লাগার পরই নেমে আসে ঢল। চৈত্রের এ অকাল বন্যা কৃষকের স্বপ্ন বোনা ফসল পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে তাদের জীবনে এনেছে ঘোর অন্ধকার।
উপজেলাগুলোর হাওরবেষ্টিত বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ফসল ঘরে তোলার সময়ে সর্বস্বান্ত হওয়া কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে ইউনিয়নে ইউনিয়নে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।
অষ্টগ্রামের কাস্তুল ইউপি সদস্যের অফিস সংলগ্ন চালাঘরের সামনে ত্রাণের চালের অপেক্ষায় ছিলেন অর্ধশতাধিক গৃহস্থ ও নারীরা। ব্যাগ হাতে এসেছে শিশু-কিশোররাও।
ঘরে চাল না থাকায় সকালে শূন্য হাঁড়ি উনুনে চড়ানো হয়নি মাজেদা, ফুলবানু, ভগবতী রাণী ও কুলসুমদের।
মাজেদার ভাষ্য, ‘২ একর জমি চাষ দিছিলাম। পানি সব কাইড়া নিছে। অহন ঘরে খাওনের চালও নাই। চাল নিয়া বাড়ি ফিরলে তবেই চুলোয় আগুন দিবো’।
তবে কাস্তুল ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল হক রন্টি জানান, সহায়তার এ চাল নিতে আসছেন কেবল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরাই, মান-সম্মানের ভয়ে অবস্থাপন্নরা আসছেন না।
অষ্টগ্রামের আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের অবস্থাসম্পন্ন কৃষক রামচরণ দাস (৪২) বলেন, ‘বছরের একমাত্র ফসল তলিয়ে যাওয়ায় আর ধান তোলা সম্ভব হয়নি। ঘরে ঘরে অসময়েই অভাব হানা দিয়েছে। খোরাকির ধানটুকুও হারিয়ে নি:স্ব হতে হয়েছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক গৃহস্থকেও’।
বড় হাওরের অষ্টগ্রাম প্রান্তে ৫ একর জমিতে ফসল ফলিয়েছিলেন আহাম্মদ আলী (৪০)। এর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ জমির ধান কাটতে পেরেছেন।
সদর ইউনিয়নের কলাপাড়া গ্রাম লাগোয়া এ হাওরেই ১৭ একর ফসলি জমি ছিল আঙ্গুর মিয়ার। অথচ ধান কেটে আনতে এক শতাংশ জমিতেও কাঁচির ফ্যাস লাগাতে পারেননি। শেষ সম্বলটুকুও পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় হতাশ এ কৃষকের বক্তব্য- ‘কতো টাকা খরচা করলাম। এক মুঠো ধানও পেলাম না’।
অষ্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক দেবপদ চক্রবর্তী বলেন, ‘হাওর তো বটেই, বাড়ির পাশের জমিও তলিয়েছে। রোদ না থাকায় পানির নিচে থেকে ধান তোলা যাচ্ছে না। নি:স্ব গৃহস্থ ঘরে তালা দিয়ে পরিবার নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছেন’।
কলাপাড়া গ্রামের ধণাঢ্য পরিবারের গৃহবধূ মোর্শেদা তালুকদারের মতে, ‘হাওরের জন্য উন্নত জাতের ধানের বীজ জরুরি। যেটি অগ্রহায়ণে রোপণ করলে ফাল্গুনের শেষের দিকে কাটা সম্ভব হবে’।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৭
এমএএএম/এএসআর