ঢাকা, সোমবার, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

অর্ধেক নদী কি করে বইবে এতো পাহাড়ের পানি

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৭
অর্ধেক নদী কি করে বইবে এতো পাহাড়ের পানি ভৈরবে একই স্থানে তিনটি সেতুর প্রশস্ত স্প্যান। ছবি: অনিক খান

হ‍াওরাঞ্চল ও ভৈরব ঘুরে: তিন তিনটে সেতুর আজদাহা স্প্যানে মাথা খুঁটছে প্রমত্তা মেঘনা। তার বুকে মেঘালয়, আসাম আর ত্রিপুরার তাবৎ পাহাড় থেকে নেমে হাওর ডুবিয়ে বয়ে আসা বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালন পানি। দু’পাড় থেকে চেপে নদীটাও বোতলের গলার মতো সরু হয়ে এসেছে এখানে।

ব্রিটিশ আমলে গড়া লাল রেল সেতুটা মাঝখানে। এর বড়জোর ৫০ মিটার উত্তরদিকে ক’বছর আগে তৈরি সড়ক সেতু।

দক্ষিণে এরও কম দূরত্বে সদ্য তৈরি রেল সেতু।

মাত্র শ’ খানেক মিটার জায়গায় গড়া এই তিন সেতুর অন্তত ২৪টি অতিকায় স্প্যান গ্যাঁট হয়ে বসে আছে অকাল বর্ষায় বাড়বাড়ন্ত নদীতে। মেঘালয়, জৈন্তা-খাসিয়া আর ত্রিপুরা পাহাড় শ্রেণির পানি নামার এই একটাই পথ।

এসব পাহাড় শ্রেণি থেকে বৃষ্টির ‍পানি ‍অন্তত ২১টি সীমান্ত নদী হয়ে বাংলাদেশে এসে প্রথমে জমা হচ্ছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিস্তৃত হাওরে। চেরাপুঞ্জিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাতের পানিও এই পথেই ভারত থেকে নামছে। তারপর হাওর ডুবিয়ে ভৈরবে এই তিন সেতুর নিচ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সব পানি। মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরা  থেকে আসা সব নদীর প্রবাহ হাওরের দিকে।  মানচিত্র।

কিন্তু, একে তো সেতুগুলোর উভয় প্রান্তে পাড় এগিযে এসে দেড় কিলোমিটার প্রস্থের নদীকে পরিণত করেছে ৫০০ মিটার চ্যানেলে, তারওপর একটার চেয়ে আর একটা সেতুর স্প্যানের অবস্থান পৃথক লাইনে। তাই অন্তত ১শ’ মিটার প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে স্প্যানগুলোর নিরেট গোড়া।

সড়ক সেতুতে স্প্যানের মাঝে জলপ্রবাহের জন্য কিছুটা ফাঁকা রাখা হলেও দুই রেলসেতুর স্প্যানের গোড়া আরো প্রশস্ত বক্স আকারের। ঢলের পানি তাই বাধা পাচ্ছে স্প্যানগুলোর গোড়ায়। ফলে হাওরে পানি বাড়ছে প্রতিদিনই। আর বন্যা পরিস্থিতি নিচ্ছে ভয়াবহ রূপ।  

মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা ভোগাই কংস সীমান্ত পেরিয়ে শেরপুরের নলিতাবাড়িতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। একই পাহাড় থেকে সুমেশ্বরী নেমে নেত্রকোনার দুর্গাপুরে, নিতাই নদ ধুবাউড়ায়, চিতল খালী নদী ঝিনাইগাতিতে প্রবেশ করেছে বাংলার সীমানায়। মেঘালয় থেকে আরো নামা উপদাখালী নেমেছে সুমেশ্বরী হয়ে কমলাকান্দায়।

ভারতের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় থেকে নেমে যাদুকাটা বা রক্তি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে। একই থানার সীমানায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে জালুখালি।

আসাম-মেঘালয় এর পাহাড় বেয়ে এসেছে ধলা নদী। জৈন্তাপুরে বাংলাদেশে নেমেছে লোভাছড়া।

আসাম থেকে আসা বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জে অমলসিদে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কুশিয়ার ও সুরমা নাম নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় থেকে ছাতকের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে জালিয়া ছড়া। ওম নদী থেকে গোয়াইনঘাটে বাংলাদেশে ঢুকেছে সারি গোয়াইন আর জাফলং ডাউকি।

আসামেরই পাহাড়ি অঞ্চল থেকে নেমে বিয়ানিবাজারে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সোনাই বরদল।

ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে কুলাউড়ায় মনু নদী, কমলগঞ্জে ধলাই নদী, কুলাউড়ায় জুরি নদী আর শ্রীমঙ্গলে লংলা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

একই পাহাড় শ্রেণি থেকে নেমে চুনারুঘাটে খোয়াই ও সুতাং নদী, মাধবপুরে সোনাই নদী পেরিয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত।

এসব নদীর পানি মূলত সুরমা, কুশিয়ারা আর ধনু হয়ে জমা হচ্ছে হাওরে। আরো অনেক শাখা প্রশাখা জালের মতো বিছিয়ে হাওর জুড়ে আন্ত:সংযোগ গড়েছে এসব নদীতে।
উভয় পাশের সেতুর গোড়ার দিক থেকে ছোট হয়ে এসেছে  মেঘনা।  ছবি: অনিক খান
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে বাউলাই নদীতে মিশেছে সুমেশ্বরী। বাউলাই নদী থেকে বেরিয়ে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে মেঘনায় মিশেছে ধনু। মিঠামইনে ধনু থেকে বেরিয়ে ‍কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে মেঘনা ও কালনিতে মিশেছে ঘোড়াউতরা।

তার আগে পাকুন্দিয়ার কাছে ব্রহ্মপুত্র থেকে বেরিয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনার কাছে নরসুন্দা ও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় ভোগাই কংস নদী পতিত হয়েছে ধনুতে।  

আর নেত্রকোনার দুর্গাপুরে কংস নদে পড়েছে নিতাই নদ, শেরপুরের নালিতাবাড়িতে চিতল খালী পড়েছে ভোগাই কংসে।

এছাড়া বাউলাই নাম নিয়ে জামালগঞ্জে ধনুতে মিশেছে যাদুকাটা-রক্তি, মোহনগঞ্জের কাছে মিশেছে উপদাখালী।

ছাতকের কাছে সুরমায় পড়েছে জালিয়া ছড়া ও উমিয়াম বা শীলা নদী, দোয়াববাজারে সুরমায় মিশেছে চিলাই ও নয়া গাঙ। যাদুকাটা বা রক্তি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে, সারি পিয়াইন নদী সিলেটের কোম্পানিগঞ্জে, সারি গোয়াইন ও জাফলং ডাউকি ‍নদী গোয়াইনঘাটে সুরমায় পতিত হয়েছে। সুনামগঞ্জে সুরমায় আরো পড়েছে জালু খালি।
বড় হাওরের এই ধানক্ষেতও ডুবে গেছে গত ক’দিনের বৃষ্টিতে।  ছবি: অনিক খান
বিয়ানিবাজারে কুশিয়ারায় পড়েছে সোনাই বরদল, ফেঞ্চুগঞ্জে জুরি, মৌলভীবাজারে মনু ও লংলা। তার আগে কমলগঞ্জে মনুতে মিশেছে ধলাই।    

দিরাইয়ে কালনীতে মিশেছে সুরমা। পুরাতন সুরমা ও কুশিয়ারার মিলিত স্রোত দিরাইয়ে কালনী নাম নিয়ে মেঘনায় মিলেছে অষ্টগ্রামে।
এছাড়া হবিগঞ্জের লাখাইয়ে কালনীতে পড়েছে খোয়‍াই, সুতাং, সোনাই।

এছাড়া জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র থেকে বেরিয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মেঘনায় মিশেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র।

এতো নদীর পানির বহন করার ক্ষমতা কি আর অর্ধেক হয়ে পড়া মেঘনায় আছে?  যদিও মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ভৈরব পয়েন্টে প্রায় দুই ফুট বেড়ে বুধবার (২৬ এপ্রিল) ৩.৫৪ মিটার গভীরতা নিয়ে পানি প্রবাহের খবর নিশ্চিত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি) এর স্থানীয় পরিমাপ স্টেশন। কিন্তু উজান থেকে নেমে আসা এতো পানি অপসারণে এই প্রবাহ অপ্রতুলই বটে। এক যুগ আগেও ভরা মৌসুমে মেঘনা এখানে ১৫ মিটার গভীর বলে পাওয়া যাচ্ছে পাউবো’রই রেকর্ডে।

আরও পড়ুন
** ঢলের ঘায়ে দাদনের ছিটা
** চোখ তবু হাওরের জলে
* * ডুবে যাওয়া ফসলের দ্বীপগ্রাম
** তবু যদি কিছু মেলে
** গরু মরবে ঘাসে
** সামনে এবার মরার বছর
** মাছ নাই রে ভাই
** ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে


বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।