পৃথিবীর তাবত সন্তান জানে- এ এক কঠোর সময়। বাবা-মা অপেক্ষায় আছেন সন্তানের একটি চাকরি হবে।
সন্তান অপেক্ষায় থাকে ধরবে সে সোনার হরিণ। এই করে, সেই করে। বিসিএস পরীক্ষায় বসে। কারো হয় কারো হয় না।
কিন্তু বাবার কী আর তর সয়! সারাক্ষণই জানতে চান, কবে হবে চাকরি?
সমাজ-শিক্ষা-চাকরি ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা সন্তানটি বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে। এই হবে, হয়ে যাচ্ছে। তারই মধ্যে একটি-দুটি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি-মিথ্যা তথ্য। হয়ে গেছে বাবা একটা ভালো চাকরি। আর অপেক্ষা করতে হবে না। আর নয় কঠোর শ্রম। এবার আনন্দের দিন এলো।
সামান্য মিখ্যার আশ্রয়ে যদি আনন্দে ভরে থাকে বাবার অবুঝ মন- তাতে কীই ক্ষতি!
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের মহেশপুরের স্নাতকোত্তর মনিরুল ইসলাম রাজু তার বাবাকে হয়তো সেভাবেই বলেছিলেন। কেউ জানতে পেতো না। বাবাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনিতো বসেও নেই। একটা কিছু হয়েই যাবে। অপেক্ষার দিনগুলো শেষ হবেই হবে!
কিন্তু মনিরুল বুঝতে পারেননি, তার মিথ্যাটুকু কতবড় সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন বাবা। সংগ্রামী মানুষটি সংগ্রামের দিনগুলো শেষ হওয়ার উচ্ছ্বাসে বিভোর হয়ে ভাসছিলেন। আর ঘটনাক্রমে সে আনন্দ প্রকাশ করে ফেললেন এক সংবাদকর্মীর কাছে।
তাতে রিপোর্ট হয়ে গেলো- ‘রিকশাচালক বাবার ঘরে বিসিএস ক্যাডার ছেলে’।
মনিরুলের বাবা নান্দু সরকার এই সংগ্রামী মানুষটি। সাদুল্যাপুরের মহেশপুরে জমি-জিরেতে ফসল ফলানোই তার কাজ। কিন্তু সংসার কখনো কখনো আর চলতে চায় না। তখন, অনেককে লুকিয়ে, ছেলেকেও না জানিয়ে ঢাকায় এসে রিকশা চালান। গত ৬ মে তার সেই রিক্সায় চেপে বসেছিলেন বাংলানিউজের সংবাদকর্মী সোলায়মান ডালিম হাজারি।
ডালিম বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট হিসেবে ফেনী থেকে কাজ করেন। রাজধানীতে এসেছিলেন অন্য একটি কর্মসূচিতে। রাতে ধানমন্ডি এলাকায় তিনি আরোহী হন নান্দু সরকারের রিকশায়। তখনই কথায় কথায় এই রিকশাচালক জানান, তার ছেলের কথা। ছেলে তার বিসিএস পাস করেছে। এখন তার কষ্টের দিন শেষ হতে চলেছে।
এমন একটি তথ্যে সংবাদকর্মী আগ্রহী হবেন এমনটাই ঠিক। ফলে বাংলানিউজে রিপোর্ট হলো।
যাতে প্রতিবেদক লিখেছেন- `নান্দু সরকার। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। এখনও মধ্যরাতে রিকশা চালান। এক বুক স্বপ্ন তার, সে স্বপ্নই তাকে মাঝরাত অব্দি জাগিয়ে রাখে, রিকশার প্যাডেলে পা রাখতে সাহস যোগায়। ছেলে একদিন অনেক বড় হবে, সেদিন সব পরিশ্রম শেষ হবে। তার স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ পেতে চলেছে, ছেলে মনিরুল ইসলাম রাজু ৩৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখন বুঝি অবসরের সময় এসেছে তার। ’
বাংলানিউজের খবরের সাথে যে ছবিটি প্রকাশিত হয়েছে তাতে ফুটে উঠেছে ছেলের অর্জনে নান্দু সরকারের মনের সকল খুশি।
এভাবেই গল্পটা শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু খবরটি সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর তাতে সকলেই নান্দু সরকার ও তার ছেলে মনিরুলকে বাহবা দিতে থাকেন।
তাতেই বিপাকে পড়ে যান মনিরুল। বাবাকে দেওয়া তার সান্ত্বনার সামান্য মিথ্যা জীবনে এত বড় বিষয় হয়ে ধরা দেবে ভাবতেও পারেননি। বন্ধুরা তাকে ফোন করে জানতে চাইছেন- তিনি কী সত্যিই বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছেন?
সে তথ্য বাংলানিউজের কাছে এসেও পৌঁছায়। শুরু হয় তত্ত্ব-তালাশ। জানা যায় তার বাবার দেওয়া তথ্য মতোই মনিরুল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেছেন। তার এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল ছিলো সে তথ্যও সঠিক। কেবল সঠিক নয় তার ৩৫তম বিসিএস-এ কোয়ালিফাই করার তথ্যটি। প্রকৃতপক্ষে মনিরুল এই বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
বাংলানিউজের কথা হয়েছে মনিরুলের সাথে। তিনি এখন মরমে মরে যাচ্ছেন! কি করবেন বুঝতে পারছেন না।
তবে আমরা মনে করি, অবুঝ বাবাকে শান্ত রাখতে যে সামান্য মিথ্যার আশ্রয় তিনি নিয়েছিলেন তা এমন কোনও বড় অপরাধ নয়। বুকে হাত দিয়ে কজনই বলতে পারবেন, জীবনে কম-বেশি এমন মিথ্যাচার বাবা-মায়ের সাথে করেননি! অনেকেই করেছেন। মনিরুল তাই বিচ্ছিন্ন কেউ নন!
তবে নিঃসন্দেহে তিনি অসাধারণ। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়ে দেশের অন্যতম সেরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্টে স্নাতোত্তর সম্পন্ন করেছেন সেরা ফল করে। সেটাই অনেক বড় অর্জন। সে অর্জন তার নিজের যেমন, তার বাবারও তেমন।
যে ঘটনাটুকু ঘটে গেছে তা তাদের জীবনে বড় কোনও প্রভাব ফেলবে না আশা করি। পুরো ঘটনাকে সন্তানের অর্জনে এক দরিদ্র বাবার উচ্ছ্বাস হিসেবে দেখতে হবে।
মনিরুলের প্রতি ব্যাঙাত্মক হওয়ারও কিছু নেই! তিনিতো তার বাবাকে খুশি রাখতেই নিয়েছিলেন সামান্য মিথ্যার আশ্রয়। কারণ তিনি জানেন, তিনি পারবেন। অতীতেও পেরেছেন সামনেও পারবেন।
আমরা মনিরুলের সেই অর্জন দেখার অপেক্ষায় রইলাম। আর ছেলের অর্জনের খবরে এরই মধ্যে নান্দু সরকারের মুখে যে অমলিন হাসি ফুটে উঠেছে তা আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হোক সে প্রত্যাশাই করি।
বাংলাদেশ সময় ২২০৪ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৮
এমএমকে