ঢাকা, বুধবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

পোড়া শরীর বয়ে বেড়াচ্ছে মিয়ানমারে নির্যাতনের চিহ্ন

মাহবুব আলম, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৭
পোড়া শরীর বয়ে বেড়াচ্ছে মিয়ানমারে নির্যাতনের চিহ্ন শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা-ছবি- সোহেল সরওয়ার

কুতুপালং (উখিয়া, কক্সবাজার) ঘুরে: বাবা-মা আর ভাই-বোন নিয়ে আর দশটা মেয়ের মতোই নিজের ভূবনে বেড়ে উঠছিলো রাখাইনের আকিয়াব জেলার মংডু থানার তুলাতুলি এলাকার সবিকা খাতুন (১৫)।

বর্তমানে পোড়াশরীরের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে কোনোরকমে বেঁচে আছেন তিনি।
 
১৫ বছর বয়সী এ কিশোরীর দগ্ধ হাতে-পা, মাখার ক্ষতচিহ্ন যেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের চিহ্নের জানান দিচ্ছে।

কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নতুন ব্লকে সম্প্রতি একটি তাঁবুতে গিয়ে দেখা যায় সবিকাকে। তার এখন কেউ নেই, এক মামা-মামি ছাড়া। তাদের সঙ্গেই এখানে থাকছেন তিনি।
 
মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) বাংলানিউজকে তিনি জানান তার ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগদের চালানো নির্যাতন-জুলুমের কথা। নিজের চোখের সামনেই বাবা-মা, ভাই-বোনকে মরতে দেখেছেন। অনেকটা অধিক শোকে পাথর হয়ে আছেন তিনি।
 
সবিকা জানান, প্রথমে মগরা এসে তাদের ঘর থেকে বের হয়ে কোথাও যেতে মানা করে। তখন তারা একটি ঘরেই ছিলেন। এরপর দুপুরে মগসহ সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য এসে নারী-পুরুষদের আলাদা হয়ে যেতে বলে।
 
তখন নারীরা একটি ঘরে, আর পুরুষরা অন্য একটি ঘরে আশ্রয় নেন। এক পর্যায়ে পুরুষদের ধরে ধরে গুলি করে। পরে তারা মৃত পুরুষদের কুপিয়ে হত্যা করে।
 
এরপর নারীদের বিশেষ করে তরুণীদের ওপর চলে জুলুম-নির্যাতন। সবিকার ভাষ্যমতে, আঁরে মাথার মধ্যি বাড়ি মারে মগরা। আই চেতন ন পাই। পরে আর ওপর জুলুম চালাইজ্জে হেতারা, ঘরত আন দিয়া, আরারে ফালি দিই-ই।
 
সবিকার মামী সখিনা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, পাশাপাশি সাতটি পরিবার থাকতেন তারা। প্রত্যেকের ঘরের সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে ১২ জন। সবিকার আরও চার-ভাইবোন ছিল। কিন্তু কেউ-ই আর বেঁচে নেই।

শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা
 
নির্যাতনের কথা ফুটে ওঠে তার কথাতেও। তিনি জানান, সবিকার বাবার নাম আলী আহম্মদ। মা রহিমা বেগম। আহমাদ উল্লাহ ও রফিকুল্লাহ নামে তার দু’টি ভাইও ছিল। কিন্তু প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে তাদের মেরে ফেলেছে মগরা।

পাহাড়-জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে ১৬ দিন হেঁটে আঞ্জুমানপাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন তারা। ‘বোটত করি নদী পার অইয়া আরা এডে আইস্যি,’ বলছিলেন তিনি।

মংডু থানার বলিবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. ইলিয়াস (৫০)। পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনিও আশ্রয় নিয়েছেন কুতুপালং শিবিরে। তিনি বলেন, বায়াজি আরার হালত জমি, গরু-ছল (ছাগল) সবই হেডে আছে। কিন্তু অত্যাচার-নির্যাতনের লাই (কারণে) জন্মভূমি ছাইড়া এডে আইস্যি।  

একই কথা জানালেন মংডুর বুথিডং এলাকার মো. সিরাজউল্লাহ (৪০)। বুথিডংয়ে তার একটি মনোহারি দোকান ছিল। দেশ ছাড়ার তা পুড়তে দেখেছে চোখের সামনে।

বলেন, আরারে একখান ঘরত নিয়া মগরা অন (আগুন) দিয়া ফালাই। ট্যাহা পয়সা না আনিত ন পারি। পোয়া-মাইয়া লই এডে আইস্যি।

গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে সহিংস দমন-নিপীড়ন শুরু হয়। সহিংসতার মুখে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে ছুটে আসছে রোহিঙ্গারা। যা এখনও অব্যাহত।

ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন সংস্থা জানায়, বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে প্রথম রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করে। ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। পরে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির পর রোহিঙ্গাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যায়।  

১৯৯২ সাল থেকেই কুতুপালং ও নয়াপাড়ায় দু’টি আশ্রয় শিবির খোলা হয়। সেখানে ৩০ হাজারের বেশি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে। এসব নিবন্ধিত রোহিঙ্গার পাশাপাশি দেশে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়।

গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন শুরু হয়। ওই দফায় ৯২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। আর এখন সেখানে নতুন করে সহিংসতা চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।