হাতের কবজি, পিঠ, পায়ের গোড়ালিতে এখনও ক্ষত দগদগে, মাথার জখমও শুকায়নি। নাড়াচড়া করলেই ব্যথার তোড়ে উ-আঁ।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ‘বি’ ব্লকে মামা-মামীর সঙ্গে রাষ্ট্র থেকে বিতারিত হয়ে তাঁবুতে আশ্রয় নেওয়া সবিকা এ কথা জানায়।
সে বলে, ‘আঁর বাবার নাম আহাম্মদ উল্লাহ। আরও চাইরজন ভাই আছিল। হেতারা আঁর ভাই বাবা-মারে মারি ফেলাইয়্যে। ’
কৈশোরের এ সময়েই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগদের অত্যাচার-জুলুমের শিকার এই কিশোরী জানান, অন্যদের সঙ্গে এখানে ক্যাম্পে থাকতে তার ভালো লাগে না। কিন্তু নিজ দেশে খুব কষ্ট পেয়ে এখানে এসেছেন।
‘বেইন্যা বেলা হেতারা (মগ ও সেনাবাহিনী) আঁরার পাড়াত আইয়ে পইলা আঁর ঘরত আইয়ে। আঁই আর আঁর চাচাতো বইনরে ধরি লই যায়। পরে আঁর মাথাত বাড়ি মাইজ্জি, আই আর কিছুত চেতন ন পাই,’ নিজের ভাষায় বলছিলেন সবিকা।
ক্যাম্পে ঝুপড়ির মতো তাঁবুর দরজায় যখন সবিকার সঙ্গে কথা হচ্ছিল সেখানে এসে জড়ো হন আরো বিশ-পঞ্চাশেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। এ সময় নিজ থেকেই বলে চলেছিলেন একেক জনের দেশত্যাগের করুণ গল্প।
সেখানে প্রতিবেশী ইলিয়াস উল্লাহ, মো. ইছলাম, মো. সিরাজ উল্লাহ, মো. ফারুকদের সঙ্গে ছিলেন সবিকার মামী সখিনা বেগম ও মামা নুরুল উল্লাহও।
শরণার্থী হওয়ার গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে এতিম সবিকার দিকে তাকাচ্ছিলেন বারবার। তিনি বলেন, আমরা কেউ ভাবিনি সবিকা বাঁচবে। বোনের স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে মৃতপ্রায় ভাগ্নিকে কাঁধে নিয়ে পাঁচদিন পায়ে হেঁটে এখানে এসেছি। পরে এখানে ক্যাম্পের হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এখন একটু একটু করে ভালো হয়ে উঠছে সে।
এতোদিন পোড়া শরীরে কোনো কাপড় রাখা যায়নি সবিকার। তাই লোকলজ্জার কারণে কিছু জানানো হয়নি বলে জানালেন সবিকার মামী সখিনা।
মিয়ানমারে নির্যাতনের বর্ণনা করে তিনি জানান, তাদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয় না। গরু-ছাগল ও গোলার ধান এসে নিয়ে যায় মগরা। কারণে-অকারণে মারধর করে এবং ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সখিনার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের কষ্ট আর নির্যাতনের কথা বলছিলেন রশিদা বেগম। চারমাস আগে চালশে (বয়স চল্লিশ থেকে ৪৯ এর ঘরে পরে হবে) কৃষিকাজ করতে গিয়ে আর ফেরেননি তার স্বামী সাইফুল্লাহ। দুইসন্তানকে নিয়ে অপেক্ষা করে স্বামীর খোঁজ না পেয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন রশিদা।
তার ভাষ্যমতে, ‘আঁর সোয়ামির হবর নঅ পাই। বহুত কষ্ট পাই পইন্দো আর মাইয়্যারে লই এডে আইস্যি, আঁরার দেশ বর্মাত কিন্তু হেডে যাইতাম নঅ। (আমার স্বামীর কোনো খবর পাইনি। অনেক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখানে এসেছি। আমাদের দেশ মিয়ানমার। কিন্তু সেখানে যাবো না। )
তার সঙ্গে কষ্টের কথা যোগ করেন মংডুর তুলাতুলির বলিবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. ফারুকও। তিনি জানান, মংডুর একটি স্কুল থেকে ২০০৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। অথচ কোনো কাজ করতে পারেননি তিনি।
তার একভাই মালয়েশিয়া থাকেন। সহিংসতায় বাবা-বোন আর সহায়-সম্বল হারিয়ে মা এবং বউ ও দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর নাফ নদী পেরিয়ে আঞ্জুমানপাড়া দিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে।
বলেন, এখানে ত্রাণ আর কিছু টাকা পয়সাও পাচ্ছি। ছোটভাই মালয়েশিয়া থেকেও টাকা পাঠিয়েছে। আমাদের ফেরত নিলে এবং অত্যাচার না করলে ফিরে যাবো।
জানতে চাইলে সবিকা বলেন, নির্যাতন করলেও আমি বেঁচে গেছি। তবুও বর্মা তো আমারই দেশ। ‘নঅ কাটিলে, নঅ মারিলে বর্মাত ফেরত যাইয়্যুম,’ বলেই কেঁদে ফেলে সে।
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে নতুন করে সহিংস দমন-নিপীড়ন শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে ছুটে আসছেন রোহিঙ্গারা। গত কয়েকদিন ধরে গড়ে দেড়-দুইশ’ পরিবার শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে প্রবেশ করছেন বাংলাদেশে। পরে সেখান থেকে টেকনাফ আসার পর তাদের নিবন্ধন করে ত্রাণ দিয়ে ক্যাম্পে পাঠাচ্ছে সেনাবাহিনী।
তবে এখনও কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়াচ্ছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৭
এমএ/জেডএম