ঢাকা, সোমবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

সুন্দর সময় স্মরণ করে একান্ত প্রহর কাটে: প্রিয়ভাষিণী

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২২ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৮
সুন্দর সময় স্মরণ করে একান্ত প্রহর কাটে: প্রিয়ভাষিণী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

বাইরে ঝুম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি দিনেই পাশাপাশি বসে নিজের খুব প্রিয় দুই বান্ধবী সাঈদা কামাল আর জোছনা মাহবুবা হাবীবকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন তিনি।

সুন্দর করে সাজানো ঘরটা ধানমন্ডির শিল্পাঙ্গন আর্ট গ্যালারির একটি কক্ষ। গত আগস্টে এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, অধিকারকর্মী ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর শেষ প্রদর্শনী।

সেখানে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার অপ্রাকাশিত অংশ পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো।

একটুও ঘরে ফেরার তাড়া ছিল না সেদিন। অবশ্য থাকবেই বা কি করে, নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলোকে তিনি ছড়িয়ে নিয়ে বসেছেন চারপাশে। পরেছেন কমলা রঙের শাড়ি। তার সঙ্গে ম্যাচিং করে পরেছেন গলার মালা। কপালে লাল-কালো টিপ আর উজ্জ্বল চেহারার ভুবনময়ী স্নিগ্ধ হাসির মায়ায় ডুবে যাবেন যে কেউ। তাইতো মধুর সে সময়ে ভাগ বসাতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে তার এমন আলগোছে কাটানো সময়গুলো সম্পর্কে।

‘অবসর সময়গুলো এখন আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেই। আড্ডা একটা দারুণ অনুভূতি জোগায় এই বুড়ো বয়সে। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে জীবনের সুন্দর সময়গুলো কথায় চেপে হুট করে সামনে চলে আসে। সেসব সুন্দর সময় স্মরণ করে আমার একান্ত প্রহর কাটে। মাঝে মধ্যে ঘর গোছাই, অগোছালো ঘর ভালো লাগে না আমার। এছাড়া রান্নাতেও একটা বড় সময় কাটে। আর সবচেয়ে বেশি সময় কাটে আমার কাজগুলোর সঙ্গে গল্প করে। ’ধানমন্ডির শিল্পাঙ্গন আর্ট গ্যালারিতে প্রিয় দুই বান্ধবী সাঈদা কামাল আর জোছনা মাহবুবা হাবীবকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। হাসতে ভালোবাসা এ মানুষটি অবসরে অবশ্য আরো একটি কাজ করতেন। তা হলো গান শোনা। তার প্রিয় গান রুবি নোমানের গাওয়া ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়/হে মন বলাকা মোর অজানার আহ্বানে/ চঞ্চল পাখা মেলে ধর’। প্রিয় গানের সঙ্গে প্রিয়ভাষিণীও পাখা মেলতেন, উড়ে গিয়ে ডুব দিতেন রবীন্দ্রলোকে। পাশে বসে থাকা তার বান্ধবী জোছনা মাহবুবা হাবীব জানালেন তেমনটাই।

তিনি বলেন, ‘প্রিয়ভাষিণী ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রভক্ত। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা, গানের সঙ্গে ওর যেন একটা প্রেম আছে। তাছাড়া এই শিল্পী এতটাই রাবীন্দ্রিক যে, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা আর বিভিন্ন চরিত্রের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায় ওর কাজের মধ্যে। ’

গ্যালারিজুড়ে তার ভাস্কর্য। ‘ওর দৃষ্টিটা অন্যরকম। প্রিয়ভাষিণী জীবনকে যেভাবে দেখে, সেটা আমার কাছে বড্ড আশ্চর্য লাগে। ওর স্পিরিট টা অসাধারাণ। আর ওর কাজগুলোও অপূর্ব। আমরা রাস্তায় দেখি একটা কাঠের টুকরো পড়ে আছে, অথচ প্রিয়ভাষিণী ওই টুকরো থেকেই একটা নতুন কিছু সৃষ্টি করবে। মূল্যহীনকে শিল্পগুণে অমূল্য করে সবার সামনে তুলে ধরবে। ’ ভাস্কর্যগুলো ঘুরে দেখার পর মনের কথাগুলোই যেন বলে দিচ্ছিলেন শিল্পীর বন্ধু সাঈদা কামাল। তাইতো জানতে ইচ্ছে হয় গাছের গুঁড়ি আর লতাপাতা ব্যবহার করে যেসব শিল্পকর্ম, তার শুরুটা কীভাবে হলো!

সাবলীল হাসিতে প্রিয়ভাষিণী বলেন, ‘যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম, আশেপাশে পড়ে থাকা জিনিসগুলো নিয়ে ভাবতাম, এগুলো দিয়ে কি কিছু করা যায় না? তারপর সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই আস্তে আস্তে বানাতে শিখলাম। এরপর মনে হলো এগুলোকে কীভাবে আরো একটু সুন্দর করা যায়! যেনো আরো কয়েকটা দিন একটু বেশি টিকে! এসব পাগলামো চিন্তা থেকে নিজে নিজে শিখতে চেষ্টা করেছি। একসময় দেখলাম অন্যরাও পছন্দ করছে, প্রশংসা করছে। ওই জায়গাটাই আমার আগ্রহ বাড়িয়ে দিলো। আমি হাতে একটি সরল রেখাও আঁকতে পারি না, অথচ দৃষ্টি দিয়ে সারাদিন ছবি আঁকি। ’

এসময় কথা হয় তার শেষ প্রদর্শনীটি নিয়েও। এতে ঠাঁই পেয়েছিলো তার বাউল, বন্য প্রেম, প্রকৃতি, বানভাসি, শ্রাবণ কন্যা, জলে ভাসা, মমি মা, আহ্বান, শান্তির প্রতীক, জলপুত্র, নৃত্যের তালে তালে, মৌনতা, ঘরে ফেরা,  মমতাময়ী, ভাবনা, জল কুমারী, মান ভাঙানো, শিশুবেলা, শৈশব, ভোরের পাখিসহ নানান শিরোনামে প্রায় শতাধিক ভাস্কর্য। চারুকলায় ছোট্ট শিশু শ্যাওলার সঙ্গে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। প্রদর্শনী সম্পর্কে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, ‘প্রদর্শনী তো পুরনো কথা। তবে প্রতিটি প্রদর্শনী আমার কাছে আমার জন্মদিন উদযাপনের আনন্দের মতো লাগে। কাজগুলোর একটিকে অন্যটির থেকে অভিনব মনে হয়, যেন আগেরটার তুলনায় নতুনটা আরো বেশি ভালো। এছাড়া বিখ্যাত শিল্পী রফিকুন্নবীর প্রদর্শনী যেখানে ৪/৫টি, সেখানে আমার প্রদর্শনীর সংখ্যা ১৮ ছাড়িয়েছে ভাবলেও বেশ লজ্জা লাগে। ’ বলেই বেশ খানিকটা হাসেন তিনি। হাত বাড়িয়ে বন্ধুদের হাত ধরে তাকান তাদের দিকে।

একটু পরেই আবার মুখ তোলেন। বলেন, ‘আমার ঘরে সবগুলো একত্রে একসঙ্গে রাখার থেকে প্রদর্শনীতে সবগুলো কাজ আলাদা জায়গা দিয়ে দেখতে বেশ ভালো লাগে। ঘরে তো একটুখানি জায়গাতে সবগুলো জমিয়ে রাখতে হয়, কিন্তু এখানে সবাই কেমন অনেকটা করে জায়গা পায়। এটা অনেকটা আমার প্রিয় শিল্পী রুবি নোমানের গানের মতো, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়। ’ আমার ঘর ছোট হলেও আমার প্রদর্শনীর গ্যালারিটা আমার কাছে আকাশের মতো। ’

দর্শকদের নিয়ে বলেন, ‘প্রতিটি শিল্পেরই তো দর্শক আছে। আমার এটাতেও দর্শক আসছে, ভালো লাগছে। শিল্প তো অনুভবের বিষয়। এগুলো দেখার পর দর্শকের মনে যদি অনুভূতি জাগে, তাহলেই শিল্পী সার্থক। শিল্পীর কাজ সার্থক। ’

সেদিন প্রদর্শনীতে ঠাঁই পাওয়া ভাস্কর্যগুলোর সঙ্গে একপাশে দেখা মিলেছিলো এ শিল্পীর ‘নিন্দিত নন্দন’ বইটির। তবে সে সম্পর্কে আর কথা হয়নি। পরবর্তীতে আবার দেখা হয়েছিলো অক্টোবরে ৯ তারিখ সন্ধ্যায়; শেষ দেখা। সেদিন সাদা শাড়ি আর লাল টিপ পরে তিনি এসেছিলেন চারুকলার একটা প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। আর সবার মাঝে ছোট্ট ‘শ্যাওলা’তেই তিনি যেন খুঁজে পেয়েছিলেন আনন্দ। বলছিলেন, ‘ওকে আমার খুব ভালো লাগছে। কেমন প্রাণবন্ত! ঠিক যেন আমার ছেলেবেলা!’

সেই ছেলেবেলার মাঝেই একটুখানি জানতে চাওয়া হয়েছিলো তার ছেলেমানুষি লেখালেখি নিয়ে। শ্যাওলাকে পাশে বসিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার আর লেখালেখি! কি লিখতে কি লিখেছি! লিখতে বসলেই আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই। খেই হারিয়ে ফেলি! আমার বইটাও তারই প্রমাণ। একটু পড়লেই বুঝতে পারবে, শুরু করেছি একটা বিষয়, মাঝখান থেকে কীভাবে কীভাবে যেন আরো একটা কথা উড়ে এসে জুড়ে বসে গেছে!’

সত্যিই তাই। উড়ে আসা আর কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসগুলোই তার জীবনটা রাঙিয়ে দিয়ে গেছে। স্থাপনা ও ভাস্কর্য শিল্পের মাধ্যমে বসার ঘর, ঘরের দেয়াল, বারান্দা কিংবা বাগান চত্বরে নিসর্গ রচনা, ঝরনা বা ফোয়ারার বিন্যাসসহ তার হাজারো ভাস্কর্য বারবার দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাদের মনে জাগিয়েছে অনন্য এক সুখানুভূতি।  

সেই সুখের অনুভূতি থেকেই তিনি লিখেছেন, ‘স্মৃতি (আত্মজীবনী) কখনো শেষ হয় না। প্রতিদিনই কোন না কোন স্মৃতির জালে আমরা আবদ্ধ হই। ’ আর সে স্মৃতির জালে জড়িয়েই তিনি পথ হাঁটলেন। আমাদের ছেড়ে মেঘেদের সঙ্গী হওয়ার পথে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৮
এইচএমএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।