ঢাকা, শুক্রবার, ৯ মাঘ ১৪৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বঙ্গবন্ধু খবর রাখতেন, এখন আর কেউ দেখে না

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
বঙ্গবন্ধু খবর রাখতেন, এখন আর কেউ দেখে না মেহেরজান বিবি

ফেনী: ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। খুব সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ মনি এসে ডেকে নিয়ে গেলো ছয় সন্তানকে। রাতে হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দিলো ঘরবাড়ি। সেই যে সন্তানরা গেল আরতো ফিরে এলো না। বঙ্গবন্ধু যতদিন ছিলেন খবর নিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর কেউ আর তেমন খবর রাখেনি।’ অশ্রুসিক্ত চোখে বাংলানিউজকে কথাগুলো বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধে স্বামী হারানো ও ৬ শহীদ সন্তানের জননী মেহেরজান বিবি। 

৯০ ছুঁই ছুঁই মেহেরজান বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। দু'মুঠো ভাতের জন্য এখন ভিক্ষে করতে হয় তাকে।

সব হারিয়ে ঠাঁই হয়েছে শহরতলীর ধর্মপুরে আশ্রয়ন প্রকল্পের ভাঙাচোরা একটি কক্ষে।  

শনিবার (২৪ মার্চ) বিকেলে জীবনের গল্প বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন তিনি, তার সঙ্গে কাঁদছিলো এলাকার মানুষও।  

তিনি বলছিলেন, এক সময় সাজানো সংসার ছিল তার। রাজধানীতে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকও ছিলেন। সন্তান আর স্বামী নিয়ে বেশ সুখের ছিল তার সংসার। কিন্তু হানাদাররা তার সে সুখ কেড়ে নেয়। এখন তিনি রাস্তার ফকির।  

এই বয়সে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিন কাটছে তার। পাশে কেউ নেই, আছে বেঁচে থাকা ও দিনযাপনের চরম আকুতি।

তিনি ১৯৩০ সালের ১০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ইব্রাহীম উকিল, মা-বিবি হনুফা। পৈতৃক নিবাস ছিল চাঁদপুর সদর উপজেলার বাবুর হাটের দক্ষিণ তরপুর চন্ডী গ্রামে।  

তার তিন ভাই এবং তিন বোন। পরে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ৬ নম্বর চরছান্দিয়া ইউনিয়নের বড়ধলী হাজী বাড়ির মরহুম মমতাজ উদ্দিনের ছেলে সুবেদার এ টি এম সামসুদ্দিনের (পরে মেজর) সঙ্গে বিয়ে হয়।

পঞ্চাশের দশকে বড়ধলী গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হলে নিঃস্ব হয়ে তারা শহরে চলে আসেন। রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরে থাকতেন বলে জানা গেছে।  

তিনি বলেন, ৮ ছেলে ও ২ মেয়ে ছিল। ছয় ছেলে এবং স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন।

শহীদ ছেলেরা হলেন- ছায়েদুল হক (তৎসময়ে সিলেটে রিলিফ অফিসার পদে কর্মরত), দেলোয়ার হোসেন, বেলায়েত হোসেন, খোয়াজ নবী, নুরের জামান ও আবুল কালাম।  

বাকি দুই ছেলে শাহ আলম ও শাহ জাহানের সন্ধানও তিনি জানেন না। দুই মেয়ে মরিয়ম বিবি ও হাসনা বিবি মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক হানাদাররা ক্যাম্পে নিয়ে তাকেও অত্যাচার করেছিল।

মেহেরজান জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী তার স্বামী ও ৬ সন্তানকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার জানতে পেরে মিরপুরে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।  

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তিনি ঢাকার মিরপুরে বাংলা মিডিয়াম হাইস্কুলে (বর্তমানে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়) শিক্ষিকা ছিলেন বলেও জানান।                        

মেহেরজান জানান, স্বাধীনতার পর তার দুঃখ-কষ্টের কথা তখনকার একটি পত্রিকায় ছাপা হলে তিনি বঙ্গবন্ধুর নজরে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাকে ও তার এক পুত্রবধূ করফুলের নেছাকে ডেকে নিয়ে দুই হাজার টাকা করে অনুদান দেন এবং বঙ্গবন্ধু মেহেরজান বিবিকে হজ পালন করান।

স্বাধীনতার পর স্বামী সন্তানদের শহীদ হওয়ার খবরে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিনেও তার পুরোপুরি মানসিক সুস্থতা ফিরে আসেনি। স্বজন-পরিজন সব হারিয়ে চরম অসহায়ত্বে পড়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেন তিনি।

সর্বশেষ ২০০৯ সালে ফেনী রেল স্টেশনে ভিক্ষা করতে দেখে এক রেলওয়ে পুলিশ তাকে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠান। তখন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তার পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হয় ধর্মপুর আবাসন প্রকল্পে।  

জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটে তার নাম রয়েছে। কিন্তু তিনি প্রাপ্য সম্মান পাননি প্রশাসনের কাছ থেকে।

ফেনীর জেলা প্রসাশক মনোজ কুমার রায় বলেন, ধর্মপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের সুবিধাভোগীর একজন এ জননী। তার সর্ম্পকে বিস্তারিত জেনেছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে তার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

মেহেরজান বাংলানিউজকে বলেন, দেশের জন্য স্বামী-সন্তানসহ পরিবারের ১৮ সদস্যকে হারিয়েছি। বিনিময়ে তেমন কিছুই পাইনি। মরার আগে ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে এটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
এসএইচডি/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।