১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এভাবেই রাজশাহী আক্রমণ করে পাক হানাদাররা। গভীর রাতে পেছন থেকে অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়েন ঘুমন্ত পুলিশ সদস্যরা।
২৫ মার্চ এলে পাক হানাদারদের সেই গুলির শব্দ যেন আজও ভেসে বেড়ায় পুলিশ লাইন্সের আকাশে-বাতাসে। কারণ অগ্নিঝরা মার্চের স্মৃতিময় দিনগুলির সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলো ঘটে এখানেই।
মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের চার নম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার সফিকুর রহমান রাজা জানান, হানাদারদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সহসী সংগ্রামের এক উজ্জ্বল প্রমাণ হচ্ছে রাজশাহী পুলিশ লাইন্স। সেদিনের হামলার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এখানকার পুলিশ সদস্যরা। উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হলে আশেপাশের এলাকার জনগণ পুলিশকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।
২৬ মার্চ সারাদিন ধরে চলে গুলি বিনিময়। ২৭ মার্চ সকালে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে উভয় পক্ষ গোলাগুলি না করার বিষয়ে একমত হয়। কিন্তু কথা না রেখে ওই দিন দুপুর আড়াইটার দিকে শহর কাঁপিয়ে আবারও পাক সেনারা পুলিশ লাইন্সে মর্টার শেল নিক্ষেপ শুরু করে। পুলিশ লাইন্স চত্বরে বয়ে যায় রক্তের বন্যা।
রাজশাহী পুলিশ লাইন্সের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ায় ২৮ মার্চও চলতে থাকে গুলি বিনিময়। বার বার বাঙালি পুলিশকে আত্মসর্মপণের জন্য চাপ দিচ্ছিল হানাদাররা। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর বীর সদস্যরা আত্মসর্মপণের চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে আপ্রাণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
দুপুর ২টা পর্যন্ত চলা অব্যাহত লড়াইয়ে প্রচুর সংখ্যক পাক সেনা হতাহত হয়। পাক সেনারা পদ্মা নদীর ধার দিয়ে বাঁধ অতিক্রম করে পুলিশ লাইন্সে ঢুকে পড়ে এবং বহু জীবিত পুলিশকে হত্যা করে বেয়নেট চার্জ করে। পুলিশরা তখন বুঝতে পেরেছিলেন এ অসম যুদ্ধে তারা কোনোভাবেই জয় পাবেন না। তারপরও বাঙালির মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রাজশাহীতে প্রথম জীবন দিয়েছিলেন পুলিশ সদস্যরাই।
রাজশাহী শহীদ মামুন মাহমুদ পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মাওলা জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শহীদ হন ডিআইজি মামুন মাহমুদ। ২৮ মার্চ যেসব পুলিশ শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন আর্মড এসআই এনায়েত খান, পুলিশ কনস্টেবল ওসমান খান, আব্দুর রহমান, আক্কাস আলী, রইচ উদ্দিন, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল মালেক, সিরাজুল ইসলাম, মেছের আলী, আলাউদ্দিন, আব্দুল হামিদ আব্দুল আজিজ মোল্লা, সাদেকুল ইসলাম, নিজাম উদ্দিন, একেএম সায়েম উদ্দিন, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন এবং রাজু ফজর।
৩১ মার্চ তৎকালীন রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টের ক্যাপ্টেন সোলেমান জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে ডিআইজি মামুন মাহমুদ ও এসপি শাহ মোহাম্মদ আব্দুল মজিদকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। ১১ এপ্রিল শহীদ হন এসআই দিলসাদ বিশ্বাস ও ১২ এপ্রিল শহীদ হন হাবিলদার রমজান আলী।
একাত্তরে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সের হামলায় কতজন মারা গিয়েছিলেন এর সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও, একাধিক সূত্রের দাবি পুলিশ সদস্যসহ ওইসময় কয়েকশ ব্যক্তি শহীদ হয়েছিলেন।
টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় রাজশাহী। ওই দিনই রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে উড়ানো হয় মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।
রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে শহীদ জিআইজি মামুন মাহমুদ স্মরণে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শহীদ মামুন শাহমুদ স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তাছাড়া আত্মোৎসর্গকারী পুলিশ শহীদ হেড কস্টেবল তাজেম আলী, কনস্টেবল মোসলেম উদ্দিন, আর্মড পুলিশের এসআই এনায়েত খাঁন ও এসআই বাবর আলীর নামে পুলিশ লাইন্সের ভেতরে চারটি সড়কের নামকরণ করা হয়।
পুলিশ লাইন্সের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্তম্ভটি স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মহুতিদানকারী পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে আছে। আর পাক সেনাদের হাতে শহীদদের গণকবরটি রয়েছে পুলিশ লাইন্সের পূর্ব পাশে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
এসএস/এনএইচটি