জানা যায়, তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় অনেক মানুষকে। আর হত্যার পর লাশগুলোকে একের পর এক স্তুপ করে সাজিয়ে গণকবর দেওয়া হয়।
ভাস্কর্যটির এক অংশে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’-- এরই প্রতিফলন। তাই দা, বঁটি, খুন্তি, কোচ, বর্শা, সড়কি ও বল্লম সবকিছু নিয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে তারা। পরের অংশে সবাই আধুনিক অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যুদ্ধে নামার পরে যখন যোদ্ধারা বুঝতে পারেন স্রেফ দেশীয় অস্ত্র সম্বল করে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানিদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়, তখন সবাই প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। যেখানে ছিলেন সব বয়সি নারী-পুরুষ। পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য গেরিলা কৌশল, মাঝারি আকারের অস্ত্রের ব্যবহার শেখেন তারা। ভাস্কর্যের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে প্রশিক্ষণ নেওয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। তার চোখে যুদ্ধজয়ের নেশা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে প্রতিশোধ স্পৃহার ছাপ রয়েছে। ভাস্কর্যে সবার মাথা একটু সোজা, মুখ লাল বর্ণের। এর কারণ রাগ হলে কালো মানুষের চেহারাও লাল বর্ণ ধারণ করে। আবার অন্যদিকে গণহত্যার দৃশ্যের রং ধূসর। কারণ এটি বাঙালির দু:সহ বেদনার স্মৃতি।
অপরদিকে ভাস্কর্যটির নিচের অংশে রয়েছে পানি, এটি দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ বোঝানো হয়েছে। পানির ভেতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, এটি দিয়ে ভাষার আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বোঝানো হয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সফলতায় বাংলার মানুষের মনে স্বাধীন হবার ভাবনা আসে। বাংলার মাটি, মানুষ আর ভাষা একাকার হয়ে আছে এ ভাস্কর্যে।
বর্তমানে ভাস্কর্যটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভাবর্ধক এক অপরূপ, অদ্বিতীয় শিল্পকর্ম। এর চারদিকে আছে অপরূপ সৌন্দর্যময় পানির ফোয়ারা। ফোয়ারা ছাড়লে নয়নভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয় এবং রাতের বেলায় রঙিন বাতির আলোয় এর রূপ যেন আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। তবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের নির্মম অধ্যায় তুলে ধরার এ ভাস্কর্যটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা অসম্পূর্ণ রয়েছে।
ভাস্কর্যের প্রধান নির্মাতা ভাস্কর রাসার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালে এ ভাস্কর্যের কাজ শুরু হয় আর শেষ হয় ১৯৯১ সালে। কিন্তু তা ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করা হয়। ৩ বছরে কাজ শেষ হলেও এর উদ্বোধন হতে সময় নেয় ২০ বছর।
ভাস্কর রাসা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাঁচটি ভাগে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। তা হলো: একাত্তরের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, ঘাতক, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ এবং বিজয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ভাস্কর্যে দুটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবহেলার কারণে এখনো তুলে ধরা বাকি রয়েছে অন্য তিনটি অংশ। যা শেষ জীবনে ভাস্কর রাসা শেষ করে যেতে চান। এখনো বাকি তিনটি হল, ঘাতক, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ এবং বিজয়।
ভাস্কর্যের তাৎপর্য নিয়ে ভাস্কর রাসা বলেন, এর মাধ্যমে গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর তৎকালীন প্রক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে।
ভাস্কর্যটি সামনে ও পেছনে দুটি অংশ ভাগ করা হয়েছে। এক পাশে একাত্তরের গণহত্যা, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ভাস্কর্যে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ও বেদনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৫ মার্চের কালো রাতকে। এ অংশে দেখানো হয়েছে এই রাতে ইয়াহিয়া খান মাতাল অবস্থায় আছেন। পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। গর্ভবতী মাকে অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছে। লাশ ফেলা হচ্ছে যেখানে-সেখানে। ভাস্কর্যের অংশ হিসেবে রয়েছে একটি পত্রশূন্য বৃক্ষ। যার সেসময়ের বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে। বলছিলেন রাসা।
এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, ‘দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যটি আগামীতে আরো সম্প্রসারণ করা হবে। ক্যাম্পাসে জায়গার সল্পতা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে ভাস্কর্যটির জন্য যা যা প্রয়োজন তা করা হবে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, ঘাতকদের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা সম্বলিত প্লেট সংযোজন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৮
কেডি/জেএম