খুলনার ২৩৫ খানজাহান আলী রোডের আলিয়া মাদ্রাসার সম্মুখে অবস্থিত কবির মঞ্জিল। এই বাড়ির অন্যতম মালিক হুমায়ুন কবীর আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ কর্মী ছিলেন।
এই পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন কামরুজ্জামান টুকু। সদস্যরা ছিলেন- স ম বাবর আলী, কে এস জামান, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, ডা. আসিফুর রহমান, জাহিদুর রহমান জাহিদ। এই পরিষদের প্রধান কার্যালয় ছিল কবির মঞ্জিল। বিপ্লবী পরিষদের সিদ্ধান্তে সার্কিট হাউজ, ইউএফডি ক্লাব (অফিসার্স ক্লাব) ও পুলিশ লাইনে হামলা চালানো হয়।
এই বাড়িতে বসবাসকারী শাহজাহান কবির বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন কবির মঞ্জিলের অনেক অবদান ছিল। এই বাড়িতে মেজর জলিল, এম এ আজিজ, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিনসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য এম এ আজিজ এ বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন।
‘আমার ভাই হুমায়ুন কবিরসহ আমরা মোট ছয় ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। কোনো সার্টিফিকেট নেইনি। যুদ্ধ করেছিলাম দেশের জন্য। কোনো বিনিময়ের আশায় নয়। যুদ্ধকালীন আমাদের বাড়িতে টেলিফোন ছিল। সেই টেলিফোন দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বিনা বিলে ফোন করতেন। এই ফোনটি গত বছর ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরে’ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বড় রেডিও ছিল। যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ শুনতেন। ’
শাহজাহান কবির বলেন, কবির মঞ্জিল থেকে নির্দেশ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হতো। এসব আক্রমণ চালানোর ফলে পাকিস্তানি সেনারা খুলনা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াতে লাগলো। অবশেষে তারা টেলিফোনে আড়ি পেতে বিপ্লবী পরিষদের প্রধান দপ্তর আবিষ্কার করে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সেনারা আক্রমণ করে কবির মঞ্জিল।
শাহজাহান কবিরের ছেলে তাইজুল ইসলাম তাজু বাংলানিউজকে বলেন, কবির মঞ্জিল ৭১-এর স্মৃতি বিজড়িত একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। মর্যাদাপূর্ণ এ বাড়িটির ইতিহাস অনেকেই জানেন না। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। ১১ কাঠার উপর দোতলা বাড়িটি অবহেলিত।
এ বাড়ি ঘিরে একাত্তরের সঠিক ইতিহাস সবার সামনে যাতে আসে সেই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বাড়ির নাম কেন কবির মঞ্জিল- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার বাপ-চাচা সবার নামের শেষে কবির থাকায় বাড়িটির নামকরণ করা হয় কবির মঞ্জিল।
কবির মঞ্জিলের ইতিহাস ইতিহাসবিদরা কেউ কেউ তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
সাংবাদিক ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী 'বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, ২৬ মার্চ সকালে খুলনার খানজাহান আলী রোডের আলিয়া মাদ্রাসার অদূরে কবির মঞ্জিলে একটি সভা হয়। সেই সভায় আসন্ন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তের একটি হচ্ছে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য 'বিপ্লবী পরিষদ' বা রেভ্যুলেশন কাউন্সিল গঠিত হয়।
এই পরিষদের সিদ্ধান্তে ২৬ মার্চ রাতে ৬-৭ জনের একটি দল খুলনা সার্কিট হাউস ও ইউএফডি ক্লাবে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে এই আক্রমণে আরও ছিলেন শেখ আবদুল কাইয়ুম, ডালিম, জ্যোতিষ, বিনয় ও তপন।
হাতে তৈরি বোমা, ককটেল, গোটা দু’য়েক দেশি বন্দুক ও একটি টু-টু বোর রাইফেল নিয়ে রাত সাড়ে ৮টার দিকে এই উদ্দীপ্ত তরুণ দল শহরের কেন্দ্রস্থলে পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে হামলা চালায়। হাজি মহসীন রোড ও আলতাপোল লেন দিয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে লক্ষ্যস্থলের দিকে এগোয় তরুণ দলটি। ইউএফডি ক্লাব ও সার্কিট হাউসে ছিল পাকিস্তানি সেনারা; তখন তারা খাবার খাচ্ছিল। ইউএফডি ক্লাবটি ছিল যশোর রোড সংলগ্ন, আর সার্কিট হাউস একটু ভেতরে। এ দুই জায়গাতেই তরুণ প্রতিরোধকারীরা একাধিক বোমা-ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বন্দুক ও রাইফেলের গুলি ছোড়ে।
এতে হতভম্ভ হয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। দ্রুত খাবার ফেলে তারাও পাল্টা আক্রমণ করে। এরই মাঝে তাদের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য আহত হয়। হামলাকারী তরুণরা তাদের নেতা টুকুর সংকেত মতো সবাই নিরাপদে ফিরে আসে।
মৃদু এই আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা বেপরোয়াভাবে নগরবাসীর উপর আক্রমণ চালায়। ধরপাকড়ের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে এই দলটি রূপসা নদী পেরিয়ে গিয়ে ঘাঁটি তৈরি করেন।
মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ খুলনা জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক (বর্তমান পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান) স ম বাবর আলী তার ‘স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান’ গ্রন্থে কবির মঞ্জিল সম্পর্কে লিখেছেন, কবির মঞ্জিলে গোপন বৈঠকের এক পরিকল্পনা করেছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। আরো সুবিধা, এখানে টেলিফোন ছিল, বিনা বাধায়, বিনা বিলে টেলিফোন যোগাযোগ এক মস্ত বড় সুবিধা। কবির মঞ্জিলে তাই আমাদের বৈঠকের আদর্শস্থান বলে সবাই অভিমত ব্যক্ত করলো।
‘কবির মঞ্জিল আগামী দিনগুলোতে বিপ্লবী পরিষদের সদর দপ্তর হিসেবে বিবেচিত হবে। ২৭ মার্চ সকালে অতি সতর্কতার সঙ্গে একে একে টুকু ভাই, কাইয়ুম, আমিসহ অন্যরা মিলিত হলাম এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলো যুদ্ধ অনিবার্য। যুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন অস্ত্র, রসদ, পরিকল্পনা, অর্থ ইত্যাদি। কিন্তু কে কীভাবে এই যুদ্ধ পরিচালন করবে। তখনই প্রস্তাব হলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে সবকিছু পরিচালনার জন্য একটা Revolutionary council বা বিপ্লবী পরিষদ করা হোক। ’
তখন সর্বসম্মতিক্রমে শেখ কামরুজ্জামান টুকুকে চেয়ারম্যান, ডা. আসিফুর রহমান, এস জামান, জাহিদুর রহমান জাহিদ, শেখ আব্দুল কাইয়ুম ও আমাকে সদস্য করে এই বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হলো। আরো সিদ্ধান্ত হলো যে, এই পরিয়দ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সর্বোচ্চ পরিষদ হিসেবে বিবেচিত হবেন। এই পরিষদের সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ ভবনটি এখনও অবহেলিত। সংশ্লিষ্টদের দাবি বাড়িটি ঘিরে একাত্তরের সঠিক ইতিহাস যেন সবার সামনে আসে। সরকারের কাছেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৮
এমআরএম/এএ