বুধবার (০৬ জুন) বেলা ১১টায় রাজধানীর ইন্সিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) মিলনায়তনে দুদকের এ গণশুনানি শুরু হয়। চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত।
শুনানিতে ১৫ জন ভুক্তভোগী সাব রেজিস্ট্রার অফিস সম্পর্কে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ ও তার স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েন। আব্দুর রশীদের সঙ্গে শুনানিস্থলে তার কয়েকজন সহযোদ্ধাও উপস্থিত ছিলেন। শুনানিতে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তেজগাঁওয় সাব রেজিস্ট্রার রজব আলী, গুলশান সাব রেজিস্ট্রার আসাদুল ইসলাম, সুত্রাপুর সাব রেজিস্ট্রার শাহাদাত হোসেন ও ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার।
রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা গাজী শহিদুল্লাহ শুনানিতে বলেন, ২০১০ সালে করা একটি দলিলের কপি তুলতে আমি গত রোববার তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যাই। দলিলের রশিদ হারিয়ে যাওয়ায় মূল দলিলের ফটোকপি ও জিডির কপি নিয়ে তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে সাহায্যের জন্য কাউকে খুঁজে না পেয়ে শহিদ নামে একজনের সাহায্য নেই। শহিদ জনৈক সাজ্জাদের কাছে নিয়ে যান। দুইজনে মিলে আমাকে নিয়ে যান রাসেলের কাছে। রাসেল আমার কাছে ১৩ হাজার টাকা দাবি করেন। এই টাকার জন্য কোনো রশিদ দেওয়া হবে কিনা আমি জিজ্ঞাসা করি। তারা বলেন, এটার জন্য কোনো রশিদ দেওয় হবে না। এটা অফিসের খরচ। তারা অ্যাডভান্স কিছু টাকা দাবি করেন এবং তিনদিন পর বাকি টাকা দিয়ে দলিল নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার কুদ্দুস হাওলাদারের কাছে যাই। তিনি রাসেলকে ডাকেন এবং আমাকে রাসেলের কথামতো চলার পরামর্শ দেন। টাকা না দেওয়ায় ওই দলিল আমি তুলতে পারিনি। দলিল তুলতে আমি কেন টাকা দেবো?
তিনি বলেন, তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দালাল চক্রের আস্তানা। ওই অফিসের রাসেল, শহিদ, সাজ্জাদ ছাড়া মামুন নামে আরো একজন রয়েছেন যারা মূলত সাব-রেজিস্ট্রারের ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে থাকেন।
এ বিষয়ে সঞ্চালক ও দুদক পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) নাসিম আনোয়ার সাব-রেজিস্ট্রার কুদ্দুসের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, রাসেল, শহিদ ও সাজ্জাদ তার অফিসের নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ না। তারা চা-টা এনে খাওয়ান। এবার দুদক পরিচালক কুদ্দুস হাওলাদারের কাছে জানতে চান, অফিস স্টাফ না হয়ে তবে কেন একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার রুমে তাদের যাতায়াত ছিলো? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি অভিযুক্ত সাব রেজিস্ট্রার।
এ সময় উপস্থিত সকলের পক্ষ থেকে সাব-রেজিস্ট্রার কুদ্দুস হাওলাদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত দাবি করা হলে পরিচালক নাসিম আনোয়ার বলেন, আমরা তথ্য সংগ্রহ করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেবো।
এদিকে সাভারের বাসিন্দা কামরুজ্জামান খান অভিযোগ করেন, সাভার সাব রেজিস্ট্রি অফিসে স্টাফ না এমন অনেকে থাকেন, তারাই ঘুষের টাকা হ্যান্ডেলিং করেন। নিয়ম না থাকলেও তারা সেরেস্তা ফি বাবদ ৭০০ টাকা আদায় করেন। তারা জমির শ্রেণী পরিবর্তনের মাধ্যমে বিশেষ কৌশলে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে নাসিম আনোয়ার বলেন, রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে আমরা অনুসন্ধান করব। এছাড়া সাব রেজিস্ট্রি অফিসে স্টাফ না এমন যারা আছেন সেই বিষয়টি ঢাকা জেলা সাব রেজিস্ট্রার দেখবেন। তবে যারা ঘুষের টাকা হ্যান্ডেলিং করেন তাদের বিরুদ্ধে দুদক বিশেষ কৌশলে আইনের আওতায় আনবে বলে তিনি জানান।
ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার বলেন, এসব বিষয়ে আমরা বিভাগীয় তদন্ত করব, তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শাহজাহানপুর থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী পারভিন রশীদ অভিযোগ করেন, শাহজাহানপুরের শহীদবাগে তার শ্বশুরের মালিকানাধীন একটি জমি রয়েছে। সেই জমির দাগ নম্বর ১০২২। এই জমির তিন প্লট পরের ১০২৫ নম্বর জমিটি কযেকবার বিক্রি হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারেই দলিলে চৌহদ্দি হিসেবে ১০২২ নম্বর প্লটটি দেখানো হয়েছে। এখন জমিটি বিক্রি না করেও আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
দলিলের সময় সাব রেজিস্ট্রার এ কাজ করতে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ করেন পারভিন রশীদ।
এ সময় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং জমি উদ্ধারে দুদক কমিশনারের বিশেষ উদ্যোগ কামনা করেন। বিক্রি না হলেও অন্য একটি জমি তাদের চৌহদ্দি দেখিয়ে বিক্রি হয়েছে। যে কারণে তারা জমিটি হারিছেন।
এ বিষয়ে গুলশান সাব রেজিস্ট্রার আসাদুল ইসলাম বলেন, এটা রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত বিষয় না। চৌহদ্দির বিষয়ে সাব রেজিস্ট্রারের হাত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তবে ঢাকা জেলা সাব রেজিস্ট্রার বলেন, এটা হচ্ছে জমিটি জবর দখল হয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। এছাড়া উচ্ছেদের জন্য তিনি মামলাও করতে পারেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে দেখার জন্য দুদকের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হবে বলে দুদক কমিশনার নাসির জানান।
দোহারের আবুল কাসেমের অভিযোগ, দলিল করতে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সেরেস্তা ফি নামে টাকা নেওয়া হচ্ছে। দলিল লেখকরা একটি দলিলের জন্য কত টাকা নিতে পারেন সেই বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ বিষয়ে গুলশানের সাব রেজিস্ট্রার বলেন, সেরেস্তা ফি নামে কোনো ফি নেই, এখন পে-অর্ডারের বাইরে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার বলেন, ২০১৪ সালে দলিল লেখকদের ফি সংক্রান্ত নীতিমালা হয়েছিল, কিন্তু এই নিয়ে জটিলতার কারণে সেখানে হয়রানির হচ্ছে। এই বিষয়টি আইজিআরকে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আমরা অনুরোধ জানাব।
আশুলিয়া থেকে আসা রহিম উদ্দিন বলেন, স্থানীয় সাব রেজিস্ট্রি অফিসে দালালে ভরা। সারাদেশেই একই অবস্থা বিদ্যমান। এ বিষয়ে দুদক পরিচালক নাসিম আনোয়ার বলেন, বিষয়গুলো আমরা অনুসন্ধানে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কেউ যদি ঘুষ চায়, আপনারা দেবেন না। আপনারা ১০৬ নম্বরে ফোন করে দুদকের কাছে অভিযোগ জানাবেন। ঘুষ দেবেন না এমন সংস্কৃতি চালু করেন।
কেরানীগঞ্জের বেগম বেদৌরা আলী বলেন, জমি রেজিস্ট্রারের শ্রেণী পরিবর্তন করা হয়। সেটা অহরহ হচ্ছে, এর কারণে সরকার রাস্বজ হারাচ্ছে। রেজিস্ট্রেশনের জন্য অন্যায়ভাবে হাজার হাজার টাকা নেওয়া হয়ে থাকে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এই বিষয়ে নাসিম আনোয়ার বলেন, শ্রেণী পরিবর্তন করে দলিল করার অভিযোগে গাজীপুরের এক সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। এই ধরনের আরও ঘটনা থাকলে দুদকে অভিযোগ জানাতে তিনি অনুরোধ করেন। এ সময় তিনি বলেন, সাব রেজিস্ট্রি অফিসে পাসপোর্ট অফিসের মত দালাল চক্র আছে। কমিশন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
এরপর দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনার ড. নাসির উদ্দীন বলেন, কোন একজনকে ধরে দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। এতে হয়তো একটি ম্যাসেজ সবাইকে দেওয়া যায়, অন্যায় করে পার পাওয়া যায় না। কিন্তু উৎসমুখ বন্ধ করতে না পারলে দেশের দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। এজন্য ডিজিটাইলেজেশন বা অটোমশনের কোনো বিকল্প নেই। কেবলমাত্র অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমেই সবক্ষেত্রে অনিয়ম কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ঢাকা সদর সাব রেজিস্ট্রার আব্দুল কুদ্দুস হাওলাদারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ভুক্তভোগী গাজী শহীদুল্লাহর অভিযোগকে ‘সুস্পষ্ট অভিযোগ’ হিসেবে উল্লেখ করেন ড. নাসির উদ্দীন। তিনি এ বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ সহকারে অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে কুদ্দুস হাওলাদারের জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য দুদককে নির্দেশ দেন তিনি।
ড. নাসির বলেন, সরকার বা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করা কাজ আমাদের নয়। তবে তাই বলে অন্যায় করে কেউ পার পাবে না। জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করার অভিযোগ বিষয়ে সাভার সাব রেজিস্ট্রার অফিসকে ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে নেওয়া হলো বলে জানান তিনি। আগামী এক বছর এই অফিসে যতো দলিল হয়েছে, তা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সরকারের কতো টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, তা খুঁজে বের করবে দুদক।
একইসঙ্গে ঢাকা মহানগর ও পাশের সাব রেজিস্ট্রার অফিসগুলোকে কঠোর নজরদারির মধ্যে আনা হবে এবং এইসব অফিস দালালমুক্ত করতে বারবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকারকে নির্দেশ দেন দুদকের এ কমিশনার ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
এর আগে গণশুনানির উদ্বোধন করতে গিয়ে ড. নাসির উদ্দীন বলেন, সাব রেজিস্ট্রার অফিস একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কার্যালয়। ভূমি নিবন্ধনে জনগণকে সেবা দেওয়ার স্থান। সংবিধান অনুযায়ী এই জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। তাদের করের টাকাতেই আমাদের রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়। সাব রেজিস্ট্রার অফিস থেকে সরকার বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। তবে আগের চেয়ে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। ইয়াং ছেলে-মেয়েরা সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। সাব রেজিস্ট্রি অফিসেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। অবকাঠামো খাতে সংকট আছে। অনেক অফিসের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। মূল্যবান রেকর্ড পত্র নষ্ট হচ্ছে। সাব রেজিস্ট্রারদের গাড়ি নাই। সরকারকে বলবো এসব অবকাঠামো ও লজিস্টিক দুর্বলতা দূর করতে।
অনুষ্ঠানে মহা নিবন্ধক (আইজিআর) খান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, আমরা যারা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’, যারা বড় অফিসার হয়ে যাই, তারা অতি অহংকারে নিজেরা নিজেদের রাষ্ট্রের মালিক যে জনগণ তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। আমাদের সামনে সেবা নিতে আসা মানুষগুলোকে আমরা আমাদের ভাই বা পিতা ভাবতে পারি না। সাব রেজিস্ট্রার অফিস সম্পর্কে যে নেতিবাচক কথা শোনা যায়, তার পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণও আছে। আমাদের সামনে কিছু বেরিয়ার আছে। এর সবচেয়ে বড় বেরিয়ার হলো দলিল লেখকরা। সেখানে গিয়েই জনগণ প্রাথমিকভাবে ভোগান্তিতে পড়েন এবং অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েন। তাই জনগণের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলার, আপনারা দলিল লেখক ও আমাদের কর্মকর্তাদের লালসা থেকে সতর্ক থাকবেন। মনে রাখবেন , আমরা যেন জমির শ্রেণী পরিবর্তন না করে দলিল করি। কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ, অফিস টাইম শেষেও যদি হাতে কাজ থাকে, তা যেন শেষ করেই অফিস থেকে বের হই। এজন্য যেন জনগণের ভোগান্তি না হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০১ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৮
আরএম/এমজেএফ