ঢাকা, শুক্রবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পূর্বাচলে স্টেডিয়ামের জায়গা দখল করে নীলা মার্কেট

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৮
পূর্বাচলে স্টেডিয়ামের জায়গা দখল করে নীলা মার্কেট নীলা মার্কেটের একাংশ, ছবি: শাকিল আহমেদ

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) ঘুরে: রাজধানীর পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় স্টেডিয়ামের জন্য ২০ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রায় দুইশ পরিবারকে সরিয়ে এই জমি বরাদ্দ দেয় রাজধানী উন্নয়ন  কর্তৃপক্ষ(রাউজক)। তবে স্টেডিয়ামের এই জমিতে দখলবাজদের দখলরথ থামছে না।

‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’ ও  চার থেকে পাঁচ শতাধিক দোকানপাট গড়ে নাম দেয়া হয়েছে ‘নীলা মার্কেট’। শাক-সবজি, তৈজসপত্রের দৈনিক হাটও জমে উঠেছে সেখানে।

মসজিদ-মাদ্রাসার স্থাপনা বানিয়ে স্টেডিয়ামের জায়গাটি স্থায়ীভাবে দখল করার পাঁয়তারাও চূড়ান্ত।
 
গত পাঁচ বছরে অনেকবার নীলা মার্কেট উচ্ছেদ করেছে রাজউক। এরপরও থামছে না স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলদারিত্ব। দখলবাজদের দৌরাত্ম্যে এক ধরনের অসহায়ত্বই প্রকাশ করেছে রাজউক।
 
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রায়ই নীলা মার্কেট উচ্ছেদ করি। একদিকে উচ্ছেদ করি, তার উল্টা দিক থেকে আবারও টিনের ঘর করে দোকান বসানো শুরু হয়ে যায়। কারণ ১৫ দিন দোকান বসলেই টিনের ঘরে টাকা উসুল হয়ে যায়। নীলা মার্কেটে নানা ধরনের ব্যবসা লেগে আছে। এখানে একটা চক্র গড়ে উঠছে তাদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠছি না। তবে আমরা উচ্ছেদ অভিযান থামাবো না।  

আমরা যে অসংখ্য বার নীলা মার্কেট উচ্ছেদ করেছি তার প্রমাণ পাবেন পেপার-পত্রিকা দেখলে।  
এখন প্রতি তিন মাস পরপর উচ্ছেদ অভিযান চালানোর কথা ভাবছেন বলেন জানান আনোয়ার হোসেন।
 
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মহাপরিকল্পনায় জাতীয় ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৭ দশমিক ৫০ একর জমি । মোট জমি থেকে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জন্য ২০ একর জমি বরাদ্দ রাখা হয়। প্রথমে রাজউক নিজেরাই এটি নির্মাণ করতে চাইলেও পরে এই জমি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে থাকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে বরাদ্দ দেয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) স্টেডিয়ামটি করার কথা। অথচিএরই মধ্যে জমি দখল হয়ে বেহাত হয়ে গেছে।
 মার্কেটের ভেতর কাঁচাবাজার, ছবি: শাকিল আহমেদপ্রায় দুই থেকে আড়াইশ পরিবারকে সরিয়ে দিয়ে স্টেডিয়ামের জায়গা বের করা হয়। অথচ সাধারণ মানুষের ক্ষোভ তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া জমিতে অবৈধভাবে জেঁকে বসেছে নীলা মার্কেট।

ভোলানাথপুরের নবির হোসেনরা মোট চার ভাই। জমি ছিল ৮ বিঘা। ১৯৯২ সালে তাদের কাছ থেকে জমি নেয়া হয়। এই জমিতে গড়ে ওঠার কথা স্টেডিয়াম। অথচ এখন এখানে মাথাচাড়া দিয়েছে নীলা মার্কেট। একে ঘিরে চলছে দুর্বৃত্তদের জমজমাট আখড়া।
 
নবির হোসেন বলেন, শুনেছি স্টেডিয়াম হবে আমাদের জায়গায়। এখন কবে হবে কইতে পারি না। তবে নীলা মার্কেট বড় হচ্ছে। নীলা মার্কেট হবে জানলে জমি দিতাম না।
 
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নীলা  মার্কেটে পাকা, আধা পাকা কয়েকশ’ দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পাঁচশ দোকানপাটের আলাদা কাঁচাবাজারও গড়ে উঠেছে সেখানে। এসব দোকানঘর থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়; প্রতিদিন বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ও পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে প্রতি দোকান থেকে আকার ভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে চাঁদাবাজ চক্র।
 
মার্কেটকে ঘিরে ভোলানাথপুরসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের আস্তানা।  শুধু তাই নয়, নীলা  মার্কেটের আশপাশটি নির্জন। অভিযোগ আছে, সেখানে ঘুরতে আসা এক শ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল তরুণ তরুণী জড়িয়ে পড়ছে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে।
নীলা মার্কেটের একাংশ, ছবি: শাকিল আহমেদ নীলা  মার্কেটের সামনেই রয়েছে একটি কবরস্থান। অভিযোগ উঠেছে, এ কবরস্থানের ভেতরেই মাদকের মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে। মাদকের খুচরা কেনাবেচাও চলে এখানে। আর তা করা হচ্ছে কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজউকের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে।
 
বেশ কয়েকটি দোকানঘরের পজেশেও বিক্রি করা হয়েছে। এক একটি পজেশন এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এসব টাকা আদায় করে থাকেন জনৈক ফটিক মিয়া।
 
রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর আগে সেখানে গড়ে তোলা হয় একটি ক্লাবঘর। এটির নাম দেওয়া হয় ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব। ’ নীলার স্বামী ফটিক আলম ও দেবর আনোয়ার হোসেন এ ক্লাবটি পরিচালনা করে থাকেন। তাদের নেতৃত্বেই ‘আওয়ামী লীগ ক্লাব’ ঘেঁষে একের পর এক দোকানপাট গড়ে ওঠে, চলতে থাকে পজেশন আকারে জায়গা কেনাবেচা। দেখতে দেখতেই সেখানে কয়েকশ দোকানপাটের বিরাট বাজার জমে উঠেছে। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলার নামেই অবৈধ এ বাজারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নীলা মার্কেট’।
 
সেখানে একেকটি দোকানের পজেশন মূল্য বাবদ তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা এককালীন আদায়ের পাশাপাশি ভাড়া হিসেবে দোকানপ্রতি দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।  
 
তবে রাজউকসূত্র বলেছে, অবৈধভাবে গড়ে তোলা নীলা মার্কেটটিতে অন্তত চার দফা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই উচ্ছেদ শেষে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আবারও সেখানে দোকানপাট নির্মিত হয়। এরপরও একাধিকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশের সহায়তার অভাবে তা সফলতার মুখ দেখেনি।
 
রাজউক সূত্রগুলো জানিয়েছে, খুব শিগগির আবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করে জায়গাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছেন না বাসিন্দারা।
 
এখন জবর দখল স্থায়ী করতে দখলবাজরা পরস্পরে আইনি জটিলতা বাঁধিয়ে মামলা মোকদ্দমা সৃষ্টির চক্রান্ত চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।  

৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে খোলামেলা ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে। সড়কের আশপাশের এলাকাগুলো অতি নির্জন। এজন্য বিভিন্ন স্থান থেকেই মানুষজন এখানে ঘুরতে আসেন। এদের একাংশকে টার্গেট করেই নীলা মার্কেট ও আশপাশ এলাকায় বসানো হয় জুয়া ও মাদকের আসর।  র‌্যাব, পুলিশসহ প্রশাসনের চোখের সামনেই জবরদখলের পাশাপাশি অসামাজিক কর্মকাণ্ড চললেও তারা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
 
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, মোটা অঙ্কের টাকায় পজেশন কিনে এরই মধ্যে সেখানে পাকা আধা পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে চালানো হচ্ছে দোকানপাট। তাদেরকে নোটিশ দিয়ে,মাইকিং করে কিংবা বুলডোজার দিয়ে সহজেই উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে না। সেখানে ক্ষতিপূরণের দাবি দাওয়া নিয়ে নতুন জটিলতা বাঁধানোর ধান্ধাবাজি চালানোরও ফন্দিফিকির চলছে। ফলে নির্ধারিত স্থানটিতে স্টেডিয়াম গড়ে তোলার কাজটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

অবৈধভাবে স্থাপিত ‘নীলা মার্কেট’ উচ্ছেদ না করে এর অনুমোদন চেয়ে রাজউক বরাবর একটি আবেদনপত্র দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। কিন্তু রাজউক কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেয়নি। এরই মধ্যে জায়গাটিতে অবৈধ মার্কেট গড়ে তোলাসহ দখলবাজি, চাদাঁবাজি ও ক্ষমতার বাণিজ্য করে প্রভাবশালী চক্রটি মাসে ১০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
 
এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা  বলেন, এমপি সাহেবের নির্দেশে পূর্বাচলের প্রস্তাবিত স্টেডিয়ামের জায়গায় এ অস্থায়ী বাজারটি বসানো হয়েছে। এখানকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন নিজেদের উৎপাদিত ফল-ফসলাদি এ বাজারে বেচাকেনা করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।  

বাজারটিকে ঘিরে কোনোরকম অনিয়ম ও চাঁদাবাজির অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৮
এমআইএস/জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।