এদিকে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর একে একে চাপ আসছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
জাতিসংঘ ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো মিয়ানমার সেনাদের অভিযানকে ‘স্পষ্ট গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছে। গেল সপ্তাহেই যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গাদের পক্ষে আলোচনার ঘোষণা দিয়েছে এবং আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো নৃশংসতার বিচারের এখতিয়ার রাখে বলে সর্বসম্মত রায় দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা এটাকে বাংলাদেশের বছরব্যাপী চালানো কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বিজয় হিসেবেই দেখছে।
অন্যদিকে সব বিষয়ে মিয়ানমারের অসহযোগিতা এবং অস্বীকার করা, নেতিবাচক প্রচারণা, মিথ্যা ও ভুল ছবি ছাপানোর মাধ্যমে প্রোপাগান্ডাকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম মাহমুদ আলী। সম্প্রতি তিনি বলেন, এটাই তাদের পক্ষে (মিয়ানমার) করা স্বাভাবিক।
বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান রাষ্ট্রগুলোর জোট আসিয়ানের সভাপতি এ অঞ্চলের অন্যতম শংকর সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। ছোট এ দ্বীপ রাষ্ট্রটি একইসঙ্গে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগীও। এ কারণে তারা এ অঞ্চলের শান্তি, শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে স্থীতিশীলতা ধরে রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
সিঙ্গাপুর মনে করে, মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর, চীন সাগরসহ এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটাতে পারে। এতে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবাই। তাই তারা দ্রুত এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান চায়।
এরই অংশ হিসেবে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণানের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের কথা ছিল। এ সফরকে কেন্দ্র করে গত ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরের উদ্যোগকে স্বাগত জানান। একই সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে বলেও সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিশ্চিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।
তবে সিঙ্গাপুরের এ উদ্যোগ কতোটুকু আলোর মুখ দেখবে তা নিয়ে এরইমধ্যে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। কেননা এরইমধ্যে মিয়ানমার সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে যেতে দিতে অস্বীকার জানিয়েছে। বিষয়টিকে মিয়ানমারের স্পষ্ট অসহযোগিতা হিসেবে দেখছে সিঙ্গাপুর। গত ৪ সেপ্টেম্বর সাময়িক ভাবে ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণানের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর বাতিল করে সিঙ্গাপুর।
১০ সেপ্টেম্বর (সোমবার) ভিভিয়ানের ঢাকা সফরের কথা ছিল। সফরকালে তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করতে চেয়েছিলেন। তিনি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে রাখাইনে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মিয়ানমার সরকার রাজি না হওয়ায় তার এ সফর স্থগিত করা হয়।
সিঙ্গাপুর ১০ সদস্যবিশিষ্ট আসিয়ানের সদস্য। মিয়ানমারের সঙ্গে দেশটির অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। এর আগে গত ৪ আগস্ট আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকের পরে ভিভিয়ান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাখাইন ইস্যু নিয়ে আমরা অবশ্যই আলোচনা করেছি। সেখানে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে, সেটি নিয়ে আমরা অবশ্যই উদ্বিগ্ন। এর প্রকৃত বিষয়টি হচ্ছে, সেখানে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সমপ্রতি মিরপুরের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে আয়োজিত দেশি-বিদেশি নতুন এনডিসিদের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দেওয়া এক বক্তৃতায় সিঙ্গাপুরের উদ্যোগের কথা স্বীকার করেন।
মন্ত্রী এ সময় জানান, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সিঙ্গাপুর মিয়ানমার ও বাংলাদেশর মধ্যে একটি সেতু তৈরির চেষ্টা করছে। আমি সম্প্রতি হেলিকপ্টারে চড়ে রাখাইন সফর করে এসেছি। সেখানের পরিস্থিতি দেখে এসেছি।
এ সময় তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারের পকেষ অবস্থান নেওয়া একটি রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে কিছুই করছেনা। কেবলমাত্র ভারতের দু’টি কোম্পানি ফেব্রিকেটর বাড়ি নির্মাণে কাজ করছে। ইন্দোনেশিয়াও কিছু একটা করার কথা ভাবছে। তবে মিয়ানমারের অবস্থা হলো তারা চোখ বুজে হাত মেলায় এবং চোখের সামনের সব কিছুকে তারা অস্বীকার করে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত এক বছরে বাংলাদেশের অবস্থান সঠিকই ছিল। এটা এক ধরনের কূটনৈতিক বিজয়। জাতিসংঘের স্বাধীন ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে, বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়কে এখন সেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে, ওই রিপোর্টে বিষয়টিকে স্পষ্ট গণহত্যা বলা হয়েছে। এখানে কিন্তু ‘জাতিগত নিধন’ বা এথনেটিক ক্লিনজিং শব্দটিও তারা (জাতিসংঘ) বাদ দিয়েছে। এর অর্থ এটা একটি ভয়ঙ্কর গণহত্যা। এটা এখন আর বাইলেটারাল বিষয় নেই। এটা এখন সারাবিশ্বের সমস্যা।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের ওপর চাপ শুরু হয়েছে। বলা যায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সঠিক অবস্থানেই ছিলো। এর ফল আসা শুরু হয়েছে। সমস্যা সমাধানে সবাই বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। ফেসবুক মিয়ানমার জেনারেলদের চিহ্নিত করে তাদের নিষিদ্ধ করেছে। হয়তো তাদের নামও প্রকাশিত হবে। অন্যান্যরাও নানা ধরনের অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে।
এদিকে নেদারল্যান্ডের হেগ ভিত্তিক আইসিসি মিয়ানমারের গণহত্যা ও রোহিঙ্গা বিতাড়ন বিষয়ে বিচার করতে পারবে বলেও এক রায় প্রকাশ করেছে।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, আগামী জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমার বিষয়ে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে। ১০টি দেশ হয়তো মিয়ানমারের পক্ষে আছে কিন্তু ১৮০টি দেশই রোহিঙ্গাদের পক্ষে। তাই এর বিচার হতেই হবে। এজন্য চাপ প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। চাপ আসা শুরু হয়েছে। জেনারেলদের নাম আসছে। এরপর হয়তো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বয়কট করবে। তখন বিষয়টি আরো জোরালো হবে। তখন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়ও উঠে আসবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮
আরএম/এসএইচ