২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সেই নৃশংস গ্রেনেড হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাইফুদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজের সঙ্গে সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে কথাগুলো বলছিলেন।
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার পূর্ব গুপ্টি ইউনিয়নের মানুরী গ্রামের সফিকুর রহমানের ছেলে সাইফুদ্দিন আহমেদ।
প্রত্যক্ষদর্শী সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যবসা শেখার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ’র সালিমাবাদ ভবনে একটা কাপড়ের দোকানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সকাল থেকে মার্কেটে ছিলাম আমি। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী শোভাযাত্রার নির্ধারিত সময়ের আগেই বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী জড়ো হন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে।
সঠিক সময়টা মনে নাই, বিকেলের দিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চে বক্তব্য শুরু করেন। ফুটপাতে বসে বঙ্গবন্ধু কন্যার বক্তব্য শুনছিলাম।
শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ধুম করে প্রথম গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হয়। দৌড় দিয়ে সালিমাবাদ ভবনের ভেতরে ঢুকে গেলাম।
পরপর ধুম ধুম করে আরো কয়েকটি পেয়েছিলাম। কতগুলো শব্দ হয়েছে জানি না, তবে বেশ কয়েকটি। এরই মধ্যে যে যার মতো ছোটাছুটি শুরু করে। এ সালিমাবাদ ভবনে হুড়োহুড়ি করে ঢুকতে গিয়ে প্রবেশ পথে অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তাদের ওপরে আরো অনেকে পড়েন, মানুষের স্তুপ হয়ে যায় এখানে।
বাইরে শুধু আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। যে যার মতো ছুটে পালাচ্ছিল।
ওই মুহূত্বে মঞ্চের ওদিকটায় কি ঘটছিল স্পষ্ট দেখতে পাইনি। তবে বোঝা যাচ্ছিল নেতা-কর্মীদের অনেকে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ঘিরে ধরে মানববর্মন তৈরি করেন এবং তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেন।
এরই মধ্যে আহতদের সাহায্যে অনেকে এগিয়ে আসেন। এ সময়টাতে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে কি ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে সেটা দেখতে পাই।
কারো পা উড়ে গেছে, ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ রাস্তায় নিথর হয়ে পড়ে ছিল, শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাংসের টুকরা রাস্তায় পড়েছিল। আহতদের অনেকে রাস্তায় কাতরাচ্ছিলেন। আহতদের তুলে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছিল।
রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। শত শত জুতা রাস্তায় পড়ে ছিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অনেককে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেখি। পুলিশ এসে লাঠি চার্জ করে, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছিল। এ সময় টিয়ারশেলের জ্বালা-পোড়ায় সালিমাবাদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় উঠে যাই।
সন্ধ্যার পর মার্কেট থেকে বের হই। চারদিকে থমথমে পরিবেশ ছিল। হেঁটে বড় বোনের বাসায় যাই। বাসায় যাওয়ার পর বেশ কয়েকদিন ঠিক মতো ঘুমাতে পারিনি, ৭/৮ দিন খাওয়া-দাওয়া করতে পারিনি ঠিক মতো।
সব সময় চোখের সামনে ভেসে উঠতে ক্ষত-বিক্ষত মরদেহগুলো, মানুষের শরীর থেকে গলগলে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিছু মরদেহ, আহত নিথর দেহ চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলো। দৃশ্যগুলো বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠতো।
কোন কিছু খেতে গেলে ক্ষত-বিক্ষত মানুষগুলোর কথা মনে হতো। গলা দিয়ে খাবার নামতো না, যেনো বমি চলে আসবে।
সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এ রকম হৃদয় বিদারক দৃশ্য আমি কোনো দিন দেখিনি। সেই দিনের কথা মনে এলে গা শিউরে ওঠে। দিনটির কথা মনেও করতে চাই না।
তিনি বলেন, মানুষ মানুষের প্রতি এতটা হিংস্র হতে পারে এটা কল্পনা করা যায় না। মানুষ কিভাবে রক্ত পিপাসু হয়, মানুষ কিভাবে আরেকটা জীবন কেড়ে নেয় বুঝে আসে না। হয়তো মানুষ যখন মানবিকগুণ হারিয়ে পাশবিকতায় মেতে ওঠে তখন হিংস্র জানোয়ার, পশু হয়ে যায় এবং অপর মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতা-কর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৮
এমইউএম/এসএইচ