ঢাকা, শনিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৮ রবিউস সানি ১৪৪৭

জাতীয়

আক্রমণে ট্রেনে চড়ে কুড়িগ্রাম ছাড়ে হানাদাররা

ফজলে ইলাহী স্বপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬:২৮, ডিসেম্বর ৭, ২০১৮
আক্রমণে ট্রেনে চড়ে কুড়িগ্রাম ছাড়ে হানাদাররা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুড়িগ্রাম: ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে উত্তরের এ জনপদকে (কুড়িগ্রাম) মুক্ত করতে হানাদার বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাক বাহিনী পিছু হটতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা ট্রেনে করে কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে রংপুরের দিকে চলে যায়। শত্রুমুক্ত হয় কুড়িগ্রাম। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রথমে কুড়িগ্রাম নতুন শহরের ওভারহেট পানির ট্যাংকে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি।’

বিজয়ক্ষণের স্মৃতিচারণ এভাবেই করেন মুক্তিযুদ্ধের ৬নং সাব-সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল হাই সরকার, বীরপ্রতীক।  

তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ কুড়িগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ জেলার পুরাতন ডাকঘরের লিচুতলায় একটি জনসভায় মিলিত হয়।

১০ মার্চ জেলার প্রয়াত আহাম্মদ হোসেন সরকার ও আহাম্মদ আলী বকসীকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে মহুকুমা সংগ্রাম কমিটি করা হয়। ১৭ মার্চ স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতারা যৌথ উদ্যোগে কুড়িগ্রামের সবুজ পাড়ার চিলড্রেন পার্কে তৎকালীন ডিএসবি দারোগার ছেলে শিশু তুষারকে দিয়ে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন।  

১৮ মার্চ তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের উড্ডীন পাকিস্তানি পতাকা পোড়াতে গিয়ে গ্রেফতার হন- সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু, জোবেদ আলী সরকার, আব্বাস আলী, সুজাম মিয়া ও খোকন ঘোষ।  

২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারাদেশের মতো কুড়িগ্রাম মহুকুমার সব অফিস-আদালত ও বাসভবনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।  

সেই সময় কুড়িগ্রাম মহুকুমা প্রশাসক মামুনুর রশীদ (সিএসপি), দ্বিতীয় কর্মকর্তা আব্দুল হালীম ও তৃতীয় কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন।

২৮ মার্চ কুড়িগ্রাম সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে স্থানীয় গওহর পার্ক মাঠের জনসমাবেশে আহাম্মদ আলী বকসী, অধ্যাপক হায়দার আলী, তাছাদ্দুক হোসেন, আমিনুল ইসলাম মন্ডল, আক্তারুজ্জামান মন্ডল, রওশনুল বারী, প্রফেসর হায়দার আলী, মৃত আব্দুস সামাদ, মৃত এটিএম আফজাল হোসেন দুলালকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।  

আব্দুল হাই বলেন, একাত্তরের ৩০ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইং এর সহকর্মী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেস উদ্দিন কুড়িগ্রামে আসেন। তার নির্দেশেই নায়েক সুবেদার বোরহান উদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে কুড়িগ্রামে অবস্থান নেন। ৩১ মার্চ কুড়িগ্রামে সমবেত হয়ে এখানকার স্থানীয় পুলিশ, আনসার, ছাত্র-জনতা এবং ইপিআরদের নিয়ে একটি সম্মিলিত বাহিনী গড়ে তোলা হয়। সেসময় আহম্মদ আলী বকসীর গোডাউনকে কন্ট্রোল রুম করে টোগরাইহাটের আওয়ামী লীগ নেতা আহম্মদ হোসেন সরকারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়।

তিনি বলেন, ৫ এপ্রিল কুড়িগ্রাম চিলড্রেন পার্কের জনসভায় মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবার আহ্বান জানালে শহর জনশূন্য হয়ে পড়ে। এদিনই মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোর্য়াটার নাগেশ্বরীতে সরিয়ে নেওয়া হয়।

‘৭ এপ্রিল পাক বাহিনী সাঁজোয়া বহর নিয়ে লালমনিরহাট ও রংপুর থেকে একযোগে গুলি করতে করতে বিকেলের দিকে কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে গোলাবর্ষণ শুরু করে। এসময় কুড়িগ্রাম জেলখানার কর্তব্যরত ইনচার্জ ও ৪ জন সিপাহীকে পাকবাহিনী সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করলে সেখানেই শহীদ হন- লাল মোহাম্মদ, আনসার আলী, সাজ্জাদ আলী ও জহির উদ্দিন। ’
 
আব্দুল হাই বলেন, ১৪ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী কুড়িগ্রাম আক্রমণের চেষ্টা করে দখলে নিতে ব্যর্থ হয়। ১৫ এপ্রিল সকালে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে রেলপথ ধরে পাক বাহিনী তিস্তার দিকে পিছু হটে এবং রেললাইনের দু’ধারের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

‘২২ এপ্রিল ভোর বেলা প্রতিরক্ষার স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধারা নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জ ব্রিজটি ৩০০ গান কটন সেট করে উড়িয়ে দেয় এবং ধরলা নদীর পূর্বপাড়ে বিশাল এলাকা নিয়ে দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে,’ যোগ করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।  

তিনি বলেন, ২৭ মে একটি জিপ ও একটি ট্রাক ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ধরলা নদীর দিকে এগুলে পাকসেনাদের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন চালক রব্বানীসহ ১৬ মুক্তিযোদ্ধা। ১ আগস্ট রৌমারীর আলতাফ বাহিনী চিলমারী রেইড দিয়ে পাক বাহিনীকে পরাজিত করে বালাবাড়ী পর্যন্ত দখলে নেয়। ৪ আগস্ট পাক বাহিনী নৌপথে তিনটি গান বোট ও দুটি লঞ্চ নিয়ে চিলমারী ঘাটে পৌঁছে পরবর্তীতে নদীপথে রৌমারীর ছালিপাড়া ও কোদালকাটি দখল করে। ওই অঞ্চলে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন তারামন বিবিও।  

‘যুদ্ধ হয় ১ আগস্টেও। ওই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ১১ সৈন্য সৈন্য নিহত হয়। পাক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৫ আগস্ট অধ্যাপক আব্দুল ওহাব তালুকদার শহীদ হন। ’

আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে যেনো ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যান আব্দুল হাই। যুদ্ধের দিনগুলোতে হানাদাররা কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে বাঙালি নারীদের ধর্ষণ ও স্বাধীনতাকামী মানুষের নির্যাতন গড়ে তোলে।  

উলিপুরের হাতিয়া, কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়ী পাকবাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যা বলেও উল্লেখ করেন তিনি।  
 
তার ভাষ্য, ১৩ নভেম্বর হাতিয়ায় নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ৬৯৭ শিশুসহ নারী-পুরুষ নিহত হন। ২০ নভেম্বর রাতে নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন লে. কর্নেল আসফাকুস সামাদ। এভাবেই ১৪ নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী, ২৮ নভেম্বর নাগেশ্বরী এবং ৩০ নভেম্বর গোটা উত্তর ধরলা হানাদার মুক্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

আব্দুল হাই বলেন, ১ থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ধরলা নদী পাড়ি দিয়ে কুড়িগ্রাম শহরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চালানো হয়। এরপর শুরু হয় ভারতীয় বিমান হামলা। এভাবেই মুক্ত হয় কুড়িগ্রাম।  

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু জানান, কুড়িগ্রাম জেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা রয়েছে ৯৯জন। এর মধ্যে লে. আবু মঈন মো. আসফাকুস সামাদ বীর উত্তম (মরনোত্তর), শওকত আলী (বীর বিক্রম), সৈয়দ মনছুর আলী টুংকু (বীর বিক্রম), বদরুজ্জামান (বীর প্রতীক), আব্দুল হাই সরকার (বীর প্রতীক), আব্দুল আজিজ (বীর প্রতীক) এবং একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি (বীর প্রতীক) উল্লেখযোগ্য।

এদিকে কুড়িগ্রাম মুক্ত দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলগুলো নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ২১০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৮
এফইএস/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।