ঢাকা, রবিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

প্রতিরোধের মার্চ-৩

মুক্তিকামী জনতার দখলে ময়মনসিংহ

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২০ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৯
মুক্তিকামী জনতার দখলে ময়মনসিংহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ

১৯৭১ | গৌরব ও প্রতিরোধের মার্চ। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ময়মনসিংহ প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। ২৭ মার্চ থেকে ২৩ এপ্রিলময়মনসিংহ ছিলো হানাদারমুক্ত এবং স্বাধীন। তারপর ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শত্রুসেনা মুক্ত হয়। মাঝে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ২৩১ দিন। ছোট-বড় অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয় ময়মনসিংহের রণাঙ্গনে। কোনো যুদ্ধে হানাদাররা চূড়ান্ত বিজয় পায়নি।

একাত্তরে ময়মনসিংহ ছিলো অপরাজেয়। যুদ্ধের সময়ে ময়মনসিংহের ইতিবৃত্ত নিয়ে ৫ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান।

পড়ুন ধারাবাহিক প্রতিবেদনটির তৃতীয় কিস্তি। ছবি তুলেছেন ডিস্ট্রিক্ট ফটো করেসপন্ডেন্ট অনিক খান।

ময়মনসিংহে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস ছিলো ভয়ঙ্কর। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সড়ক ও রেলপথে ময়মনসিংহে এসে ঘাঁটি গাড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ময়মনসিংহ শহরে ও বর্তমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাদার বাহিনী অবস্থান নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ব্যবহার করে অস্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলে।

এছাড়াও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন মহকোমায় হানাদারদের ক্যাম্প হয়। হানাদারদের সাথে হাত মেলায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, রাজাকার, আলবদর-আল শামস বাহিনী।

২৭ মার্চ খাগডহর যুদ্ধে পাকিস্তানি ইপিআরদের খতমের মধ্যে দিয়ে বাঙালি সিপাহী যে জয়যাত্রা সূচনা করে, তার প্রভাবে পরবর্তী প্রায় এক মাস ময়মনসিংহ ছিলো মুক্তিকামী জনতার দখলে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এই সময় ঘাপটি মেরে ছিলো।

এই সময়টা চলছিলো আতঙ্কের মধ্যে। শত শত তরুণ-যুবক তখন মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে ঘর ছাড়ে। তাদের সবার গন্তব্য উত্তরে। ভারতের মেঘালয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং শেষে ফিরে আসে। শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ।

ময়মনসিংহ শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ময়মনসিংহের দিঘারকান্দার জনযুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।

ভালুকা এলাকায় আফসার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রাখে। টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর মতোই দক্ষিণ ময়মনসিংহে আফসার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের এক কিংবদন্তি।

হানাদার বাহিনী, রাজাকার-আলবদর বাহিনী জেলার বিভিন্ন থানা, হাটবাজার, গ্রামে গ্রামে ঢুকে ব্যাপক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ চালায়। লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করে। বিভিন্ন স্থানে গণহত্যাযজ্ঞ চালায়। বধ্যভূমিগুলোতে লাশের স্তূপ পড়ে। নদ-নদী, খাল-বিলে ভাসে লাশ আর লাশ।

যুদ্ধের দিনগুলোতে ময়মনসিংহ শহর ছিলো জনশূন্য শ্মশান। আতঙ্কের মধ্যে সন্ধ্যার পর গ্রামগুলো ডুবে থাকতো অন্ধকারে। পাক সেনাদের টহল আর রাজাকারদের ষড়যন্ত্র, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ পরিস্থিতিকে করে তোলে বিভীষিকাময়। পাক হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহে এসে প্রতিরোধের মুখে পড়ে।  

রহস্যময় থমথমে গ্রামগুলোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়েও তারা আশ্বস্ত হতে পারেনি। মুষ্টিমেয় রাজাকার ছাড়া আর সব মানুষই যে হানাদারদের ঘৃণার চোখে দেখে সেটিই ছিলো ওদের উদ্বেগের। কিছুদিনের মধ্যেই ‘মুক্তি’ আতঙ্ক পেয়ে বসে শত্রুসেনাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে গ্রাম গ্রামান্তরে অভিযান চালায়। প্রতিরোধের মুখে পড়ে প্রায়শই হতাহত হয়ে পিছু হটে।

এপ্রিলের শেষ দিকে পাক বাহিনী ময়মনসিংহে এলে যুদ্ধ পরিস্থিতি দানা বাঁধে। এই সময় যুদ্ধ বিমান ঘন ঘন আকাশে টহল দেয় ও বোম্বিং করে। এতে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি ছাড়াও অনেকে হতাহত হয়।

ময়মনসিংহ শহরের টাউন হল, সার্কিট হাউজে পাক কর্মকর্তারা অবস্থান নেয়। থানাঘাটে ডাকবাংলাকে ‘টর্চার সেল’ বানায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ডাকবাংলার পেছনেও ফায়ারিং স্কোয়াডে লোকজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়।

ছোট বাজারে একটি কূপকে বধ্যভূমি, মৃত্যুকূপে পরিণত করে। সার্কিট হাউজের উত্তর পাশে কাটাখালে কদমগাছের নীচে লাশ ফেলা হতো। প্রতিদিন, প্রতিরাত যখন তখন গোলাগুলির শব্দ, এখানে সেখানে পথচলতি লোকজনকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা চলছিলো শহরে।

শহরের লোকজন ভীতির মধ্যে আশেপাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়। সেখানেও নিরাপত্তা নেই। কখনো বোমা, গ্রেনেডের শব্দ, কখনো গুলি, আর্তনাদ, আর্তচিৎকার, ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের পালিয়ে যাওয়া আর ভয়ঙ্কর নীরবতা।

এপ্রিলের শেষে ময়মনসিংহ শহরে, শম্ভুগঞ্জে, মুক্তাগাছা, গৌরীপুরে, মধুপুর গড়ে, জামালপুরে, রসুলপুরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ব্যাপক বোমা হামলা চালায়। ২৭ মার্চ ময়মনসিংহ শহরের খাগডহরে ইপিআরের উইং হেডকোয়ার্টারের সব পশ্চিমা ইপিআরকে খতম করার পর ময়মনসিংহ সীমান্তের সব পশ্চিমা ইপিআরদের খতম করা হয়।

প্রতিরোধযুদ্ধের মধ্যে দিয়েই ময়মনসিংহে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে জেলার ফুলবাড়িয়ার লক্ষীপুর যুদ্ধ, সন্তোষপুর যুদ্ধ, হালুয়াঘাটের তেলিখালী যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য ভয়াবহ যুদ্ধ। এছাড়াও ধোবাউড়া, দুর্গাপুর-বিরিশিরি, কলমাকান্দা লেঙ্গুরা, গফরগাঁও, ভালুকা, ত্রিশাল, গৌরীপুর, ফুলপুর ও নান্দাইলে যুদ্ধ হয়।

ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রব তেলিখালী যুদ্ধের সার সংক্ষেপ জানিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, তেলিখালী যুদ্ধটি ছিলো অবিস্মরণীয়। এখানে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি ছিলো। ২০১ জন মুক্তিযোদ্ধা ৫ ভাগে বিভক্ত হয়ে এই সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

এতে ১২৪ পাকসেনা খতম হয়। মারা যায় ৮৫ রাজাকার ও ২৫ রেঞ্জার। তিনজন রাজাকার ও পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। বিপরীতে আক্তার হোসেন, শাহজাহান বাদশা, ইপিআর সদস্য ওয়ালিউল্লাহসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২১ মিত্রবাহিনীর সদস্য শহীদ হন।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, স্থানীয়ভাবে গ্রামাঞ্চলে লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, খাবার জোগান দেওয়া, হানাদারদের গতিবিধির খবর দেওয়াসহ ব্যাপক সহযোগিতা করে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনী কোনো যুদ্ধেই জয়ী হতে পারেনি। যেখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ হয়েছে সেখানেই হানাদাররা পিছু হটেছে। নিহত হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৯
এমএএএম/এমজেএফ

***মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বিজয় ময়মনসিংহে

***শহর থেকে গ্রামে যুদ্ধের প্রস্তুতি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।