শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) বিকেলে গণভবনে ব্রুনেই সরকারি সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ কথা জানান।
‘টানা তৃতীয়বার সরকার গঠনের পর ব্রুনেই ছিল প্রথম সরকারি সফর’ এমন তথ্য জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সফরকালে ব্রুনেই-এর সুলতান আমার এবং আমার সফরসঙ্গীদের প্রতি যে আতিথেয়তা ও সম্মান দেখিয়েছেন তা ছিল খুবই বিরল।
তিনি বলেন, এ সফর দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সার্বিক বিবেচনায় এ সফর দু’দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
গত রোববার (২১ এপ্রিল) স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটার দিকে সুলতান হাসানাল বলকিয়ার আমন্ত্রণের তিনদিনের সরকারি সফরে ব্রুনেই যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেখানে ব্রুনেই বিমানবন্দরে লাল গালিছা সংবর্ধনা এবং গার্ড অব অনার প্রদানের মাধ্যমে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয় শেখ হাসিনাকে। ব্রুনেই আন্তজার্তিক বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান দেশটির ক্রাউন প্রিন্স (যুবরাজ) আল-মুহতাদি বিল্লাহ বলকিয়া।
সোমবার (২২ এপ্রিল) সকাল ১১টায় ব্রুনেইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়ার সরকারি বাসভবন ইস্তানা নুরুল ইমানে যান। সেখানে দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রথা ভেঙে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মান জানিয়ে প্রাসাদের করিডোরে এসে স্বাগত জানান সুলতান হাসানাল বলকিয়া এবং ক্রাউন প্রিন্স (যুবরাজ) আল-মুহতাদি বিল্লাহ বলকিয়া।
ইস্তানা নুরুল ঈমান প্রাসাদের চেরাদি লায়লা কেনচানায় সুলতান বলকিয়া ও রাজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরে ব্রুনেই এর সুলতান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরকে ব্রুনেই এর সুলতান দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে মন্তব্য করেন।
সুলতান হাসানাল বলকিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
এ সফরে ব্রুনেই সুলতান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে কৃষি, সংস্কৃতি ও শিল্প, যুব ও ক্রীড়া, মৎস্য, পশু সম্পদ, জ্বালানি খাতে ৬টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে ব্রুনেই-বাংলাদেশ। এছাড়া দুই দেশের কুটনৈতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভিসা ছাড়া ভ্রমণ বিষয়ে একটি কূটনৈতিক নোট বিনিময় হয়েছে।
সফরে ব্রুনেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী।
ব্রুনেই এর বিখ্যাত জামে আসর মসজিদের নামাজ আদায় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া রয়েল রেজালিয়া জাদুঘর পরিদর্শন করেন তিনি।
সফরের শেষদিন সকালে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশ হাই কমিশনের নতুন চ্যান্সেরি ভবন ও দূতাবাস কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
গত ২৩ এপ্রিল দেশে ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে আমি দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে উচ্চ পর্যায়ে সফর বিনিময়, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, খাদ্য, কৃষি, মৎস্য, জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিমান যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করি।
‘ব্রুনেই-এর পক্ষে সুলতান আমার প্রস্তাবসমূহকে স্বাগত জানান এবং এগুলো বাস্তবায়নে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ’
তিনি বলেন, ব্রুনেই দারুস সালাম খাদ্য ও কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখপূর্বক এসব ক্ষেত্রে ব্যাপকভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করে। কৃষিক্ষেত্রে কারিগরি সহযোগিতাসহ যৌথভাবে খামার স্থাপন, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষিপণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সম্ভাবনা বিবেচনার বিষয়ে দু’পক্ষ একমত হয়।
‘দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চালুর জন্য সমীক্ষা পরিচালনা এবং ভবিষ্যতে দ্বৈতকর অব্যাহতি চুক্তি এবং পারস্পরিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ চুক্তির সম্ভাব্যতা বিবেচনার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, পর্যটন অবকাঠামো, পাট শিল্প ইত্যাদি প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়। ’
এছাড়া স্বাস্থ্যখাতে প্রশিক্ষণ ও পেশাজীবীদের নিয়োগ, ঔষধ উৎপাদন ও বাণিজ্য, বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ব্রুনেই ঐকমত্য পোষণ করে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, দ্বিপাক্ষিক বিনিময় ও সহযোগিতা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে দু’দেশের মধ্যে আর্থিক খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়। সামরিক খাতে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আমরা একমত হই।
শেখ হাসিনা জানান, ব্রুনেই-এর সুলতান বাংলাদেশের অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সুলতান শান্তিরক্ষা মিশনসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করেন। আসিয়ান, ওআইসি, কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘসহ (ASEAN, OIC, Commonwealth, UN) বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে মতৈক্য হয়।
তিনি বলেন, ব্রুনেই-এর সুলতান বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়া ও তাদের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সুলতান রোহিঙ্গা সমস্যার ন্যায়ভিত্তিক ও স্থায়ী সমাধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।
‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আসিয়ান দেশসমূহের অধিকতর অংশগ্রহণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন নিশ্চিত করার বিষয়ে আমি সুলতানের সহযোগিতা কামনা করি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি ওআইসি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিনিময় বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক ফোরাম গঠনের বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগের প্রতি সুলতান সমর্থন ব্যক্ত করেন। সুলতান আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন। ’
ব্রুনেই এর সুলতানকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানোর কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ব্রুনেই-এর সুলতানকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন এবং সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৯
এসকে/এমইউএম/এমএ