ঢাকা, সোমবার, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

নব্বইয়েও থেমে নেই আল্লাদীর জীবনযুদ্ধ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪০ ঘণ্টা, মে ৮, ২০১৯
নব্বইয়েও থেমে নেই আল্লাদীর জীবনযুদ্ধ আল্লাদী রানী পাল। ছবি: বাংলানিউজ

বাগেরহাট: বয়স হয়েছে ৯০ এর বেশি। নুয়ে পড়েছেন নিচের দিকে। চোখে দেখছেন কম; কানে শুনছেন না ভালো করে। এমনকি শরীর নিয়ে হাঁটতেও পারছেন না। এমন অবস্থায়ও জীবিকার টানে প্রতিদিন কাজ করতে হচ্ছে অসুস্থ এক বৃদ্ধাকে।

বয়স্ক শরীর তাকে কাজে সায় দিচ্ছে না, তবুও করতে হচ্ছে পরিশ্রম, না করে উপায় নেই। এছাড়া এ সময়ে এমনটা ভালো লাগছে না তার।

এখন আরাম করতে চান বলে আপ্লুত হয়ে জানিয়েছেন তিনি নিজেই।

বলছিলাম বাগেরহাট সদর উপজেলার গোটাপাড়া ইউনিয়নের তালেশ্বর গ্রামের পালপাড়ার আল্লাদী রানী পালের কথা। পিতা-মাতা হয়তো খুব আদর করে তার নাম রেখেছিলেন আল্লাদী। কিন্তু এ বৃদ্ধ বয়সেও শান্তি আসেনি তার।

তিন কন্যা সন্তানের মা আল্লাদী। বছর ২০ আগে মারা যান আল্লাদীর স্বামী নিমাই চন্দ্র পাল। এরপর থেকে ছোট মেয়ে রাধা রানী পালকে নিয়ে তার কষ্টের সংসার। ৪০ বছরের মেয়েটিকে বিয়েও দিতে পারেননি এখনও। এছাড়া খেয়ে না খেয়ে অভাব-অনটনে দিন যায় যার, তিনি কী করে মেয়ের বিয়ের কথা ভাববেনই।  

বিয়ে দিয়ে দেওয়া আল্লাদীর বড় দুই মেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ভারতে বসবাস করছেন এখন। বয়স্ক মায়ের খোঁজ নেওয়ার সময় নেই তাদের। হয়তো তারা সুখেই আছেন।

সোমবার (০৬ মে) সকালে আল্লাদীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ অনেক পুরানো ছোট্ট একটি টিনের ছাপড়া ঘরে থাকেন আল্লাদী। ঘরের কোনো বারান্দা নেই। ঘরের ভেতরে সামনের দিকে সানকি বানানোর জন্য মাটি রাখা। একপাশে বেশ কিছু জ্বালানি কাঠ, অন্যপাশে রান্না ঘর। ঘরের ভেতরে একটু ফাঁকা জায়গা, রাত হলে ওই ফাঁকা জায়গায় পাটি বিছিয়ে মেয়ে রাধাকে নিয়ে রাত জেগে সানকির কাজ করেন আল্লাদী।  আল্লাদীর ঘর।

সোমবার ঘরের সামনের খালি জায়গায় সানকি শুকাতে দিচ্ছিলেন আল্লাদী। প্রচণ্ড রোদে বসে সানকিগুলো এদিক-ওদিকে করে দিচ্ছিলেন বৃদ্ধা। আর মেয়ে রাধা ঘর থেকে সানকি এনে মায়ের সামনে রেখে যাচ্ছিলেন। ঠিক এসময় গিয়ে সেখানে হাজির হয় বাংলানিউজ।

মেয়ে রাধা বলছিলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে সময় কাটে মা-মেয়ের। তারপরও তিন বেলা ভাত-মাছ খেতে পারেন না তারা। কোনো দিন দুই বেলা আবার কোনো দিন তিন বেলা অর্ধ পেট খেয়ে জীবনযাপন করতে হয় তাদের।

তিনি বলেন, এতো অসহায় হওয়ার পরও সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা জোটেনি আমাদের। আমার মায়ের দিকে তাকিয়েও কেউ এগিয়ে আসেনি। ৩০০ টাকায় ৩০ কেজি চালের একটি কার্ড থাকলেও, মাসে মাসে এই টাকা এক সঙ্গে যোগাতে খুব বেগ পেতে হয় আমাদের।

কবে নাগাদ তার মা বিধবা বা বয়স্ক ভাতা এমনকি সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাবে, তা নিয়ে এখন আর ভাবেন না রাধা। তার চিন্তা শুধু মাকে কীভাবে তিন বেলা খেতে দেবে।

আল্লাদীর প্রতিবেশী দিলীপ পাল ও হরিপদ পাল বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, বহু বছর হয়ে গেছে আল্লাদীর স্বামী মারা গেছে। তারপর থেকে মেয়েকে নিয়েই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তার। এছাড়া মাটির কাজে এখন আর তেমন টাকা নেই। এই মা-মেয়ের কষ্টের টাকায় তিন বেলা খাওয়াই জোটে না তাদের।

৭৫ বছর বয়সী প্রতিবেশী তুলশী রানী পাল বাংলানিউজকে বলেন, আল্লাদী দিদির বয়স আমার থেকেও বেশি। কাজ করার সামর্থ্য তার নেই। তারপরও পেটের টানে কাজ করে। সরকার যদি আল্লাদীকে কোনো সাহায্য করতো, তাহলে শেষ বয়সে এসে খেয়ে মরতে পারতো দিদি।

আল্লাদীর মেয়ে রাধা রানী আরও বলেন, মাকে নিয়ে সবসময় খুব কষ্টে থাকি। মা এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারে না। খুব অসুস্থ, তারপরও আমাকে সহযোগিতা করেন। মার ওষুধ কিনতে মাসে অনেক টাকা খরচ হয়। এরপর দু’জনের খাওয়া। কবে যে একটু মাংস খেয়েছি, তা মনে নেই। এতো কষ্টের পরও আমরা সরকারি কোনো সহযোগিতা পাই না। শুধু ৩০ কেজি চাল পাই ৩০০ টাকা দিয়ে। এছাড়া আমাদের এখান থেকে গোটাপাড়া ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে এই চাল আনতেই আরও খরচ হয় ১৫০টাকা।  আল্লাদী ও তার মেয়ে।

এসময় আমার মা যাতে মরার আগে তিন বেলা ভাত ও ওষুধটা খেয়ে মরতে পারেন, সরকারের কাছে সেই দাবি জানাই- বলে বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাধা।  

বাংলানিউজকে আল্লাদী বলেন, শুনেছি সরকার বিধবা ও বয়স্ক ভাতা দেয়। আমার স্বামী মারা গেছে অনেক আগে। আমিতো কোনো দিন ভাতা পেলাম না। বয়সের কারণে কানে কম শুনি, চোখে কম দেখি, সোজা হয়ে হাঁটতে পারি না। তারপরও কী আমি বয়স্ক ভাতা পাবো না? আমার তো জমিজমাও নেই। ভালো ঘর নেই। একটা ঘরও কী আমি পেতে পারি না? এমন প্রশ্ন করেন আল্লাদী।

এ নিয়ে গোটাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ সমশের আলী বাংলানিউজকে বলেন, সরকার শতভাগ বিধবা ও বয়স্ক ভাতা দেয়নি।

আল্লাদী নামে কেউ কোনো দিন তার কাছে ভাতার জন্য আসেনি বলে দায় এড়িয়ে চলে যান ইউপি চেয়ারম্যান।

আল্লাদী রানী কথা বলছিলেন বাংলানিউজের সঙ্গে, এর ভিডিওটি দেখুন...

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৯
টিএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।