ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৪ মার্চ ২০২৫, ০৩ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

‘ঘরের ভেতর আর থাকার উপায় নাই’

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৯
‘ঘরের ভেতর আর থাকার উপায় নাই’

লালমনিরহাট: ঘরে চৌকির ওপর চৌকি বসিয়ে রাত কাটাইছি। পানি বাড়ায় ঘরের ভেতর আর থাকার বুদ্ধি নাই। তাই সাওয়াপোয়া (সপরিবারে) নিয়া বের হয়ে আসনো যেকোন সাগাইয়ের (আত্মীয়ের) বাড়িত যামো। পানির স্রোতে ঘরের সউগ (সব) ভাসি গেইছে।

শনিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার নিজ গড্ডিমারী গ্রামের বাসিন্দা মশিয়ার রহমান এভাবে জানাচ্ছিলেন বন্যার পানির সঙ্গে লড়াইকরে বেঁচে থাকার কথা।  

মশিউর রহমান বাংলানিউজকে জানান, নদী অববাহিকায় বাড়ি হলেও উঁচু ভিটায় বসত করতেন তারা।

বন্যার পানিতে ডুবেননি কখনো। এবারের ভয়াবহ বন্যায় তারা টানা চারদিন ধরে পানিবন্দি। পানি বাড়লে চৌকির (বিছানা) ওপর চৌকি বসিয়ে নিদ্রাহীন কাটিয়েছেন তিন দিন। খাবার হিসেবে ছিল এক মুষ্টি মুড়ি ও গুড়, আবার কখনো চিড়া-গুড়। শুক্রবার (১২ জুলাই) মধ্যরাতে পানি হঠাৎ তীব্র গতিতে ধেয়ে আসায় বিছানা পর্যন্ত পানি উঠে। পানিতে ভেসে যায় ঘরের অনেক জিনিসপত্র। টানা চারদিন পানিবন্দি থাকায় শেষ হয়ে গেছে শুকনা খাবার। তাই জীবন বাঁচাতে বুক সমান পানির অর্ধ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসেন শহরের সড়কে।

একই এলাকা থেকে আসা রুনা লায়লা বাংলানিউজকে বলেন, টানা চার দিন পানিতে থাকায় হাত-পায়ে ঘাঁ উঠেছে। প্রস্রাব-পায়খানা করার উপায় ছিল না। তাই পেটে ক্ষুদান থাকলেও পানি বা খাবার কম করে খেয়েছি।  

...স্থানীয়রা জানান, গত ৬ দিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি প্রবাহ বেড়ে গিয়ে লালমনিরহাটে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে জেলার ৫টি উপজেলার প্রায় ২০/২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন ধরে তিস্তার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। শুক্রবার দিনগত মধ্যরাতে উজানের ঢল বেড়ে গিয়ে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বেশ কিছু বাঁধ ও রাস্তা ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করে বন্যার পানি। ফলে পানিবন্দির সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। বন্যা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে এসব পানিবন্দি মানুষজনের। শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার্তদের সহায়তায় সরকারিভাবে জিআর চাল বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

সরকারিভাবে বিতরণ করা ত্রাণের চাল বা শুকনা খাবার পেয়েছেন কি না? জানতে চাইলে হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী মেডিক্যাল মোড় এলাকার হাফিজা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, পানির মধ্যে তিন দিন-তিন রাত কাটিয়েছি। এক মুহূর্তের জন্য কোনো সরকারি অফিসার বা জনপ্রতিনিধি আসেনি। যাদের বাড়ি রাস্তার পাশে বা যারা মেম্বার-চেয়ারম্যানের আত্মীয় তারাই ত্রাণ পায়। তাদের গ্রামের প্রায় চার শতাধিক পরিবার পানিবন্দি থাকলেও কেউ ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।  

একই গ্রামের জয়া রানী বাংলানিউজকে বলেন, ঘরে থাকা এক কেজি চিড়া ও মুড়ি-গুড় মাখিয়ে পরিবারের ৫ সদস্য খেয়েছি। রাত পেরিয়ে দুপুর হলেও খেতে পারিনি। দূরের এক আত্মীয় রান্না করে খাবার নিয়ে আসবে, রাতে খাবো। রান্না করার কোনো উপায় নেই। ত্রাণ বিতরণের খবর পেলেও তার ভাগ্যে জোটেনি সরকারি বরাদ্দের চাল।  

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের স্প্যার বাঁধের এমদাদুল হক বলেন, পাঁচদিন ধরে পানিবন্দি থাকলেও সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাইনি। রান্না করার সমস্যার কারণে শুকনা খাবার প্রয়োজন বলেও দাবি করেন তিনি।

এমন অভিযোগ বন্যা কবলিত এলাকার অনেকের। তবে জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ায় সবাইকে দেওয়া সম্ভব হয়নি।

মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, এ ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতো বিপুল সংখ্যক পরিবারের জন্য সরকারিভাবে মাত্র ১২ মে. টন জিআর চাল পাওয়া গেছে। যা জনপ্রতি ১০ কেজি হারে এক হাজার দুইশত পরিবারের মধ্যে শুক্রবার বিতরণ করা হয়েছে। তাই অধিকাংশ মানুষই সরকারি সহায়তার বাইরে রয়েছে। শুকনা খাবারসহ সরকারি সহায়তা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।  
 
হাতীবান্ধা উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার ফেরদৌস আলম বাংলানিউজকে বলেন, এ উপজেলার জন্য ৪০ মে. টন জিআর চাল ও আড়াই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। জনপ্রতি ১৫ কেজি হারে চালবিতরণ প্রায় শেষের দিকে। তবে শুকনা খাবার প্যাকেট করতে দেরি হওয়ায় শনিবার বিকেলে বিতরণ শুরু হয়েছে।  

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলী হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, ১১০ মে. টন জিআর চাল ও আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যাংক বন্ধ থাকায় টাকা উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। তাই বাকীতে বা অন্য কোথাও ধার নিয়ে শুকনা খাবার সংগ্রহ করে বিতরণ করতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে টাকা ম্যানেজ করতে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় শুকনা খাবার বিতরণে কিছুটা দেরি হয়েছে। শুকনা খাবার হিসেবে জেলা ত্রাণ শাখার গুদামে এক হাজার ৯৪৭ প্যাকেট শুকনা খাবার মজুদ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, তিস্তার পানি প্রবাহ মধ্যরাত থেকে সকাল ৬টায় বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও দুপুরের পর থেকে কমতে শুরু করে। বিকেল ৩টায় বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্যারেজ রক্ষার্থে সবগুলো জলকপাট খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ভারতের গজলডোবা ব্যারেজে পানি প্রবাহ বিপদসীমা অতিক্রম করায় ক্রমেই বাড়েছে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৯
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।