ঢাকা, মঙ্গলবার, ১২ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৫ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

গ্রুপভিত্তিক বখাটেপনা, বাধা দিলেই হামলা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১৯
গ্রুপভিত্তিক বখাটেপনা, বাধা দিলেই হামলা

ব‌রিশাল: দক্ষিণের জনপদে হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে গ্রুপভিত্তিক বখাটেপনা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম। বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পরপরই আলোচনায় আসে গ্রুপভিত্তিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের এ বিষয়টি। যার সূত্র ধরে আর কোনো বড় ঘটনা এ জনপদে না ঘটলেও আলোচিত হয়ে উঠেছে বখাটেপনার বিষয়টি। যাতে বাধা দিলেই ঘটছে হামলার ঘটনা।

যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, ঘটে যাওয়া সব ঘটনাকে সামনে রেখেই অপরাধ দমনে তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তরুণ সমাজকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টিও তারা গুরুত্ব সহকারেই দেখছেন।



নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে সমাজের পাশাপাশি পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে, এমন দাবি সুশীল সমাজের।

গত ২ জুলাই ভোরে বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলায় পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হন ‘জিরো জিরো সেভেন’ অর্থাৎ বন্ড বাহিনীর প্রধান নয়ন বন্ড (২৫)। যার নেতৃত্বে হওয়া হামলাতেই নিহত হন বরগুনা সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির স্বামী রিফাত শরীফ।  

রিফাত শরীফ হত্যার পরই সামনে আসে তরুণদের নিয়ে তৈরি সন্ত্রাসী গ্যাং বা গ্রুপের নাম ‘জিরো জিরো সেভেন’।

তবে এ ঘটনার পর দক্ষিণের জেলা বরিশালের কিছু জায়গায় গ্রুপভিত্তিক সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড হঠাৎ করেই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। যেসব ঘটনায় কিশোর-তরুণরাই জড়িত রয়েছেন। আর প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বর্তমানে এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন শিক্ষকরাও। এর মূল কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, বখাটেপনায় বাধা দেওয়াই ছিলো ওইসব শিক্ষকদের অপরাধ।

গত ৩১ জুলাই দুপুরে বরিশাল নগরের প্রাণকেন্দ্র সদররোডে অবস্থিত সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুজিত কুমার দেবনাথের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় বখাটেদের একটি গ্রুপ। যে গ্রুপের সব সদস্যই বয়সে তরুণ। তাদের কলেজকেন্দ্রিক নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও বখাটেপনায় বাধা দেওয়ার কারণেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে হামলার শিকার হতে হয়। যে ঘটনায় মামলা দায়ের হলে মিজানুর রহমান রুবেল নামে একজনকে আটকও করেছে পুলিশ। বাকিরা পলাতক রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের বিভিন্ন এলাকায় নানা রকমের কাণ্ড ঘটালেও এদের বিরুদ্ধে কেউই কিছু বলার সাহস পায়না। কখনো তারা ‘আব্বা গ্রুপ’ আবার কখনো ‘হাতুড়ে গ্রুপ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে সিটি কলেজ ক্যাম্পাসকে বেছে নেয় তারা। ওই সময়ে বখাটেপনার কারণে গ্রুপটির সদস্য শাকিবকে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা অবরুদ্ধ করলেও গোরচাঁদ দাস রোডের এক ছাত্রলীগ নেতা এসে ছাড়িয়ে নেয়।  

সে ঘটনার কিছুদিন আগে এ গ্রুপের সদস্যদের রেখে যাওয়া কিছু দেশীয় ধারালো অস্ত্র সিটি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৫ সালে এই গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে কলেজের ক্যাশ ভেঙে টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ তুলে মামলা দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ।   যারপর থেকেই গ্রুপের সক্রিয় সদস্য সৌরভ বালা, শাকিব, ইয়াসিনসহ সবাই কলেজ শিক্ষক ও স্টাফদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

সর্বশেষ ২৯ জুলাই ওই মামলায় কলেজ কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। সে দিনই সৌরভ বালাসহ একদল তরুণ কলেজে হামলা করতে আসে। কিন্তু পুলিশ সৌরভ বালাসহ দুইজনকে আটক করে পরিস্থিতি শান্ত করে। যার দু’দিন পরেই ওই তরুণরা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ওপর হামলা চালায়। একইসঙ্গে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিক তন্ময় তপুকেও তারা হুমকি দেয়।

এছাড়াও ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল এই গ্রুপের সদস্যরা জেলা স্কুলের মোড় থেকে ব্রাউন্ড কমাউন্ড পর্যন্ত যানবাহনে ভাঙচুর করে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অভিযোগ রয়েছে একই বছরের অক্টোবর মাসে চাঁদা চেয়ে না পেয়ে গির্জা মহল্লা এলাকার একটি মোবাইলের দোকানেও হামলা চালায় তারা। এরকম কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় এ গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে বেশকিছু মামলাও রয়েছে থানায়।

এদিকে গত ২৪ জুলাই বরিশালের বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রকাশ মালাকারের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় একটি গ্রুপের মেহেদি হাসান ও বাবু নামে দুইজন। যাদের মধ্যে মেহেদি হাসানকে তাৎক্ষণিক আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ওই দুইব্যক্তি এই কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে বখাটেপনা করে আসছিলো। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকায় তাদের বিরুদ্ধাচারণ করার সাহস পায় না কেউই। তবে কলেজ ‍উপাধাক্ষ্য বখাটেপনায় বাধা দিতে গিয়েই সরাসরি হামলার শিকার হন।

এর আগে ১৮ জুলাই বরিশালের মুলাদী চরলক্ষীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মির্জা নোমানের বাড়িতে হামলা চালায় স্থানীয় বখাটেদের একটি গ্রুপ। বাড়িতে হামলার পাশাপাশি শিক্ষক নোমানকে পিটিয়েও গুরুত্বর আহত করে ওই গ্রুপের সদস্যরা।  

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, নাজিম, শাওন, ইমন, রুমনসহ স্থানীয় উঠতি বয়সের কিছু তরুণ সেখানকার ছাত্রীদের উত্ত্যক্তসহ বিভিন্ন ধরনের বখাটেপনা করতো। যার প্রতিবাদ করতে গিয়েই হামলার শিকার হন শিক্ষক মির্জা নোমান। ওই বখাটে তরুণদের পেছনেও স্থানীয় গডফাদার থাকায় মামলা-মানববন্ধন করেও এখনো কোনো আশাব্যাঞ্জক ফল পাননি শিক্ষক নোমান।

তবে এসব বিষয় নজরদারিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এছাড়া অপরাধ দমনে তারা সক্রিয়ভাবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন বলেও দাবি করেছেন।

বরিশাল মেট্রোপলিটন (বিএমপি) পুলিশের কমিশনার শাহাব উদ্দীন খান বাংলানিউজকে বলেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি অপরাধ যাতে দানা না বাধতে পারে সেদিকেও আমরা লক্ষ রাখছি। প্রতিটি বিষয় আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। এখানে যাতে গ্যাং বা গ্রুপ কালচার গড়ে না উঠতে পারে সেদিকে আমাদের লক্ষ রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বিদ্যালয়গুলোতে কাজ শুরু করেছি। তবে এ ধরনের সমস্যা সমাধানে সমাজের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বরিশালের সাবেক সভাপতি ও অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) জাহিদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বখাটেপনা, শিক্ষকদের অসম্মান এগুলো খুবই খারাপ বিষয়। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকেই এগুলো হচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়েছে, সন্তানরা যা চাচ্ছে তাই পাচ্ছে। তারপরও কিন্তু খারাপ দিকের প্রচলনই বেশি হচ্ছে। এতে বোঝা যায় যে, নৈতিক মূল্যবোধে ভেদাভেদ রয়েছে। এজন্য পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাইকেই এক হয়ে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজেও শাসন ব্যবস্থা থাকা উচিত।

বাংলা‌দেশ সময়: ০৯৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৯
এমএস/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।