স্থানীয়রা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই সংশ্লিষ্টরা আবাসিক এলাকা থেকে সেসব কারখানা সরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই অদৃশ্য কারণে সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা থেমে যেতে দেখা যায়।
সর্বশেষ গত বুধবার (১৪ আগস্ট) দিনগত রাত পৌনে ১১টায় লালবাগের পোস্তা এলাকায় একটি প্লাস্টিকের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ১৬টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস।
সরেজমিন দেখা যায়, লালবাগের পোস্তা এলাকার ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের একটি সরু গলিতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘টিপু হাজী’র ভবন। টিনশেড ভবনটি বিশেষ কৌশলে দোতলা করে বানানো হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে ভবনের প্রায় সবটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ইটের দেয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভবনটির নিচতলায় প্লাস্টিক, পলিথিন ও জুতার কারখানা ছিল এবং ওপরের তলায় ছিল গোডাউন। বশির নামে এক ব্যক্তি বাড়িটি ভাড়া নিয়ে তিন বছর ধরে এখানে কারখানা পরিচালনা করতেন। তবে ঈদের ছুটি থাকায় ঘটনার দিন কারখানার ভেতরে কেউ ছিলেন না।
ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার মালিক বশিরের বোন আয়েশা আক্তার কারখানার দেয়াল লাগোয়া কয়েকটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার দেখিয়ে বাংলানিউজকে জানান, এই ট্রান্সফর্মার থেকেই আগুন লেগেছে। গত ৯ আগস্ট (শুক্রবার) রাতে সবাইকে ছুটি দিয়ে বিদ্যুতের সব সংযোগ খুলে গুছিয়ে রেখে তারপর মালিক বশির বাড়ি যান। তাহলে ভেতর থেকে শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, কারখানাটিতে খেলনাসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা হতো। এখানে কোনো রাসায়নিক ছিলো না। তবে আগুন লাগার পর মুহূর্তের মধ্যেই পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। কারখানায় নিয়মিত প্রায় ২০-২৫ জন শ্রমিক কাজ করলেও ঘটনার দিন সবাই ঈদের ছুটিতে ছিলেন।
কারখানাটি আগে টিনশেড একতলা ছিলো। পরে ইট দিয়ে দোতলার মতো করে উপরে গোডাউন বানানো হয়েছে। এ অগ্নিকাণ্ডে তাদের প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্র জানায়, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে প্লাস্টিক ও রাসায়নিক মিলে সবই ছিল দাহ্য পদার্থ। বুধবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস প্রথম কল পায়। এরপর দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ শুরু করে। সরু পথের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো দূরে রেখেই পাইপ টেনে পানি সরবরাহ করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, কারখানার ভেতরে আগুন নেভানোর কোনো সরঞ্জাম ছিল না।
পাশের ভবনের বাসিন্দা স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী ফজলুল বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে আগুন লাগার ঘটনায় মনে হয়েছিল আমার বিল্ডিংটাও পুড়ে যাবে। আগুন খুবই ভয়াবহ ছিলো।
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার এরশাদ হোসেন বলেন, আগুনের কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন) দিলীপ কুমার ঘোষকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক আবদুল হালিম ও উপ-সহকারী পরিচালক নিউটন দাস।
আবাসিক এলাকা থেকে কারখানা না সরানোর পেছনে কোনো প্রভাবশালী মহলকে দাবি করছেন স্থানীয়রা। অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন পণ্যের কারখানা ও গুদামের জন্য ভবন ভাড়া দেন তারা। এ বিষয়ে অন্যরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ জানালেও কাজ হয়নি। বরং সেইসব প্রভাবশালীরা বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে ব্যবসা চালু রেখেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুল এ বিষয়ে বলেন, ইসলামবাগের আগুনের পর স্থানীয়রা ঐক্যবদ্ধভাবে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সেই প্রতিবাদে বাধা দেয়। আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন কারখানা ও গোডাউনের কারণে বারবার পুরান ঢাকায় আগুনের ঘটনা ঘটছে। আর এসব আগুন দ্রত ছড়িয়ে পড়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মান্নান বলেন, অনেকবার শুনেছি পোস্তা এলাকা থেকে কারখানা উঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগুলো আর সরানো হয়নি। এসব কারখানার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত জীবন ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছি।
চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ৭১ জন নিহতসহ আহত হন আরো শতাধিক মানুষ। ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগুনের উৎপত্তিস্থল কেমিক্যাল গোডাউন হওয়ায় ভয়াবহতা ও প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডির পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পক্ষ থেক পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে প্লাস্টিক ও কেমিক্যাল কারখানা সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৯
পিএম/জেডএস