শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাঠানো রোহিঙ্গা তালিকা থেকে ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্প্রতি ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। সরকার প্রত্যাবাসনের সিদ্বান্ত দিলে তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি।
অন্যদিকে রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এখনো পর্যন্ত আমরা কিছুই জানি না। এছাড়া আমাদের দাবি পূরণ না হলে কেউই সেখানে যাবে না।
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসা শুরু করে। বর্তমানে সবমিলিয়ে মোট প্রায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে।
রোহিঙ্গারা এদেশে আসার পর থেকেই তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিতে বিভিন্নভাবে কূটনীতিক তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গঠিত দুইদেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সিদ্বান্ত মতে, ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩০টি পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার দুই দেশই প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের মুখে সেসময় প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। এরপর থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে যায়।
রোহিঙ্গারা এদেশে আসার পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তজার্তিকভাবে কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা হলেও এখনো পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
এর প্রায় ১৮ মাস পর বাংলাদেশের পাঠানো প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা থেকে সম্প্রতি আবারও ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার । সর্বশেষ দুই দেশের সম্মতিক্রমে আগামী ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরুর দিন ধার্য করা হয়।
এদিকে আগামী সপ্তাহেই এই প্রত্যাবাসন শুরু করতে দুই দেশ সম্মত হয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রচার করা হলেও এ বিষয়ে কিছুই অবগত নন বলে জানান রোহিঙ্গা নেতারা। কোনো আলোচনা ছাড়াই প্রত্যাবাসন শুরুর খবরে তারা বিস্ময়ই প্রকাশ করেছেন।
রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে গঠিত সংগঠন আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মো. মুহিব উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে শুনছি-দেখছি যে, আগামী সপ্তাহে প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা এখনো পর্যন্ত কিছুই জানিনা। তাই বিষটি শুনে আমরা রীতিমত অবাকই হচ্ছি।
মুহিব আরও বলেন, গত ২৭ ও ২৮ জুলাই মিয়ানমারের স্থায়ী পররাস্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশে আসা মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ৩৫ জন রোহিঙ্গা নেতার কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আমিও রোহিঙ্গাদের পক্ষে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছি। দীর্ঘ আলোচনার পর সেখানে সিদ্বান্ত হয়েছে, আমরা আবারও আলোচনায় বসবো এবং আগামী দুইমাসের মধ্যে তারা আবার আসবেন। আমাদের সঙ্গে সংলাপে বসবেন। আমরা এ সংলাপের নাম দিয়েছি-‘গো হোম ডায়ালগ’।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী। এজন্যই আমরা এই সংলাপের নাম দিয়েছি ‘গো হোম ডায়ালগ’। তবে কোনো ধরনের সিদ্বান্ত ছাড়াই প্রত্যাবাসনের এ খবর আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
বৈঠকে আমরা তাদের তিনটি দাবির কথা জানিয়েছি। দাবিগুলো হলো- নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও নিজ ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে দেওয়া। এসব দাবি-দাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্বান্ত না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা প্রত্যাবাসন চাই না।
মিয়ানমারের ওপর আস্থা নেই রোহিঙ্গাদের:
উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্প থেকে এক রোহিঙ্গা বাংলানিউজকে বলেন, দুই বছর ধরে এদেশের সরকার আমাদের এখানে আশ্রয় দিয়েছে। সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা আমাদের দেশে অবশ্যই ফিরে যেতে চাই। তবে আমাদের নাগরিকত্বসহ সব দাবি-দাওয়া মানলে ও প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দিলেই আমরা মিয়ানমারে ফিরে যাব। এর আগে নয়। কারণ মিয়ানমার যুগ যুগ ধরে আমাদের সঙ্গে ছলচাতুরী করছে।
একই ক্যাম্পের নূরজাহান বেগম নামে এক রোহিঙ্গা বাংলানিউজকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে বার্মা (মিয়ানমার) সরকার আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে, কিন্তু দেয়না। দাবি পূরণের আগে ফিরে গেলে তারা আমাদের ওপর আরও বেশি নির্যাতন চালাবে।
উখিয়ার জামতলীর ক্যাম্পের মো. আলম বলেন, আমাদের ভাই-বোন, বাবা-মা অনেকেই মারা গেছেন। এ অবস্থায় তারা আমাদের বার্মায় (মিয়ানমার) নিয়ে যাবে বলছে। কিন্তু আমাদের দাবি পূরণ না হলে আমরা কিভাবে যাব। রোহিঙ্গা কার্ড, নাগরিকত্বসহ সব দাবি এখানে থাকতেই পূরণ করতে হবে। অন্যথায় আমরা যাব না।
রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মো. ইলিয়াছ বাংলানিউজকে বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের একদফা বৈঠক হয়েছে। তারা আমাদের সঙ্গে আবারও সংলাপে বসার কথা বলেছে। কিন্তু হঠাৎ করে আবার কাদের প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে? বিষয়টি আমাদের বোধগম্য নয়। তাদের আচরণে আমরা বিস্মিত হয়েছি।
উখিয়ার জামতলীর ক্যাম্প-১৫ এর প্রধান মাঝি ওমর ফারুক বাংলনিউজকে বলেন, আমরা তাদের বলে দিয়েছি যে, আমরা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নেব না এবং আমরা মিয়ানমারের কোনো ক্যাম্পেও যাব না। আমরা নিজেদের বসতভিটায় ফিরে যাব। আমাদের জায়গা-জমি ফিরিয়ে দিতে হবে, নাগরিকত্ব দিতে হবে ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এরপরেই প্রত্যাবাসন শুরু হোক, এমনটিই আমরা চাই।
প্রত্যাবাসনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি জানিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র যোসেফ ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের মতামত যাচাইয়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তিন হাজার ৪৫০ জনের একটি তালিকা ইউএনএইচসিআরকে দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা ধরে কাজ শুরু করা হবে।
‘তবে কবে প্রত্যাবাসন শুরু করা হবে এটা সরকারের বিষয়। এ বিষয়ে এখন নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছেনা। ’
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২২ হাজার ৪৩২ জনের একটি তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এই তালিকা থেকে ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম আরও বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা চলছে জানি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ওভাবে কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। তবে সরকার প্রত্যাবাসনের সিদ্বান্ত নিলে আমরা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে সেই সিদ্বান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।
২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরুর যে বিষয়, সেটির অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে আবুল কালাম বলেন, এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছেনা। তবে সরকারের সিদ্বান্ত হচ্ছে, জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হবে না।
‘দুই দফায় ২২ হাজার ৪৩২ ও ২৫ হাজার সাত জনের তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদের মধ্য থেকে ৩ হাজার ৪৫০ জনের বিষয়ে মিয়ানমার ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে। ’
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তালিকা তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি ক্যাম্পে আমরা পরিবার ও গ্রাম ভিত্তিক তালিকা তৈরি করেছি। শিশু থেকে শুরু করে একটি পরিবারে যতজন সদস্য আছে, সবারই তালিকা করা হচ্ছে। এবং সেখান থেকে পরিবার ও গ্রামভিত্তিক তালিকাই আমরা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করছি।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৯
এসবি/এসএ