ঢাকা, রবিবার, ২৬ মাঘ ১৪৩১, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

বঙ্গবন্ধুর ছবি থেকে ৫৩৩ মেগাপিক্সেলের চিত্রকর্ম!

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৯
বঙ্গবন্ধুর ছবি থেকে ৫৩৩ মেগাপিক্সেলের চিত্রকর্ম!

রাজশাহী: সরকারি অফিস-আদালত ও প্রতিষ্ঠানসমূহে বর্তমানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়, তা প্রায় ৫০ বছর পুরোনো। কালের বিবর্তনে সংরক্ষণ, সম্পাদন, প্রযুক্তিগত কিছু কারণে মূল ছবি থেকে রূপান্তর হয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলোর স্বরূপ হারিয়েছে। তবে প্রায় চার বছরের কঠোর পরিশ্রম ও  গবেষণার পর বঙ্গবন্ধুর ছবির বিস্তারিত নমুনা সংগ্রহ করে তার ছবির ডিজিটাল পেইন্টিং (চিত্রকর্ম) এঁকেছেন গ্রাফিক ডিজাইনার হাবিবুল্লাহ আল ইমরান শিহান।

তিনি হাই রেজোলুশনে আঁকা বঙ্গবন্ধুর এই ছবিটির শিরোনাম দিয়েছেন ‘দ্য ফাদার’। ইমরানের দাবি, দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ছবির প্রকৃত রূপ উদ্ধার করে তার আঁকা চিত্রকর্মে তা ফুটিয়ে তুলেছেন।

উচ্চপ্রযুক্তির মাধ্যমে প্রস্তুত করা ছবিটি ১০তলা ভবনের সমান বড় করলেও রেজোলুশন বিন্দুমাত্র কমবে না এবং ফাটবে না।

হাবিবুল্লাহ আল ইমরান বলেন, প্রায় ৫০ বছর আগে তোলা বিদেশি ফটোগ্রাফারদের আর্কাইভ থেকে বঙ্গবন্ধুর অনেক ছবি তিনি সংগ্রহ করেন। এর পর বঙ্গবন্ধুর পুরনো ছবি পর্যবেক্ষণ করে বর্তমান ছবির সঙ্গে অমিল দেখতে পান।

‘দ্য ফাদার’ পেইন্টিংয়ের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন সনদবিশেষ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডান গালের তিল, দুই চোখ আর স্যুটের কাপড়ে পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বরাবরই হাতছাড়া কালো কোট পরতেন যা ‘মুজিব কোট’ নামেই সবার কাছে পরিচিত। তবে অফিসিয়াল অনুষ্ঠানে গাঢ় নীলচে আর ফ্যাকাশে চেকের স্যুটে তাকে দেখা গেছে।  

সংরক্ষণ ও কালের বিবর্তনের কারণে ছবির অনেক নমুনা হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডান গালে ছোট তিল ছিল। কিন্তু ছবি সম্পাদনার সময় সেই তিলকে ছোট নেগেটিভে ফিল্ম-স্পট হিসেবে মনে করে অনেকেই মুছে ফেলেছেন। এমনিভাবে চোখ দু’টির কন্ট্রাস্ট ধরে রাখতে গিয়ে বয়সের ভাঁজগুলো মুছে ফেলা হয়েছে।  

স্বাভাবিকভাবেই আগের ফিল্ম ক্যামেরা দিয়ে যে ডিটেইল নেওয়া হতো, তা বর্তমান ক্যামেরা বা টেকনোলজির সামনে খুবই অপ্রতুল। ধীরে ধীরে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন হতে থাকে ফটোগ্রাফি প্রযুক্তিতে। এভাবে নতুন নতুন প্রযুক্তিতে ছবিকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে এর আসল রূপ হারিয়ে গেছে। গবেষণালব্ধ হাই রেজুলেশনের ‘দ্য ফাদার’ ছবিটিতে এই বিষয়গুলো প্রকৃত রূপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে জানান হাবিবুল্লাহ আল ইমরান। ‘দ্য ফাদার’ পেইন্টিংয়ের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট, শেষ হয় চলতি বছরের ১৭ মার্চএক প্রশ্নের জবাবে এ গ্রাফিক ডিজাইনার জানান, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে ২০১৫ সালে তার ৯৫তম জন্মদিনে একটি ছবিকে প্রকৃত রূপে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা মাথায় আসে ইমরানের। তিনি গ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের এমন একটি ছবি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যেটি অফিসিয়ালি ব্যবহারের সুযোগ থাকবে ও এর আবেদন থাকবে বহুদিন।  

তাই প্রথাগত নিয়মের বাইরে নির্মাণ পরিকল্পনায় ‘দ্য ফাদার’ শিরোনামের ডিজিটাল পোর্ট্রেট পেইন্টংটি প্রস্তুত করতে প্রায় চার বছর সময় চলে গেছে। ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট কাজ শুরু হওয়ার পর শেষ হয় চলতি বছরের ১৭ মার্চ। ডিজিটাল পেইন্টিংয়ের অধিকাংশ তথ্য ও নমুনা ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। চশমাটি ধানমন্ডি ৩২নং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংগ্রহশালা থেকে দেখে নির্মাণ করেছেন তিনি।

ডিজিটাল পেইন্টিংয়ের বিশেষত্ব সম্পর্কে হাবিবুল্লাহ আল ইমরান বলেন, এডোবি ফটোশপ ও ইলাস্ট্রেটর সফটওয়্যার ব্যবহার করে পিএসবি ফরম্যাটে পেইন্টিংটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এমন ডিজিটাল পোর্ট্রেট রিস্টোরেশন বা রিক্রিয়েশন বিশ্বে বিরল। আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগের ছোট্ট ফিল্ম নেগেটিভের যে পিক্সেল ডেপ্থ ছিল, তা থেকে আকার খুব বেশি বড় করলে ছবি ফেটে যাবে। এই ডিজিটাল পেইন্টিং তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৪০০-৫০০ গুণ বড় করে। পেইন্টিংটি তৈরি করা হয়েছে ৫৩৩ মেগাপিক্সেলে।

তিনি আরও বলেন, হাই রেজোলুশনের কারণে এই ডিজিটাল পেইন্টিংটি ২৭৭×৩৭০ ইঞ্চি সাইজে প্রিন্ট করলেও এর কোনো তথ্যের একটু বিকৃতিও ঘটবে না। ছবিটি ১০তলা ভবনের সমান করা হলেও ফেটে যাবে না। উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে এডোবি ফটোশপে চার জিবি’র ওপর ফাইল তৈরি করা যায় না। সেজন্য ৩৪টি আলাদা প্রজেক্ট ফাইল করে এর কাজ করতে হয়েছে। আর সর্বশেষ মূল ফাইলের আকার ৩.৯৪ জিবি। আনুমানিক ৩৫০ ঊর্ধ্ব লেয়ার নিয়ে কাজটি শেষ করা হয়েছে।  

যেখানে ৬০ ঊর্ধ্ব লেয়ার আছে শুধু চুলের বিস্তারিত তৈরিতে। পেইন্টিংটি করতে প্রায় চার বছর সময় লেগেছে তার। কখনো একটানা ১৫ ঘণ্টারও অধিক সময় বসে থেকেছেন কম্পিউটারের সামনে। এভাবে কাজ করার ফলে তার স্পাইনাল কর্ডে ইনজুরি হয়ে যায়। শিরদাঁড়ার দু’টি ডিস্ক সরে গিয়ে হাড়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এতে ব্যথার কারণে দুই হাত নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। পরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন। গত ২৬ জুলাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে ‘দ্য ফাদার’ পেইন্টিংটি দেখান ইমরান শিহানজাতির জনকের স্মৃতিকে আগামী প্রজন্মের হাতে নতুন করে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ইমরান তার পেইন্টিংটি তুলে দিতে চান। গত ২৬ জুলাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে পেইন্টিংটি দেখান তিনি।

ইমরান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দৃঢ়তা, ত্যাগ, বীরত্ব, দূরদর্শিতা আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। এই ডিজিটাল পেইন্টংটির নিখুঁত কাজ আগামী প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন জানতে উৎসাহিত করবে। তাই ছবিটির যথাযযোগ্য ব্যবহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে আমি পেইন্টিংটি তুলে দিতে চাই। এটি দেখার পর অনেকে দাবি করছেন বঙ্গবন্ধুর মুখের ডান পাশে তিল ছিল না। প্রধানমন্ত্রীকে দেখাতে পারলে আমার গবেষণালব্ধ কাজটি সঠিক বলে প্রমাণিত হবে আশা করি। সামনের বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এটি অফিসিয়াল ছবি হিসেবে ব্যবহার হলে আমার এতদিনের পরিশ্রম সফল হবে। আর বিশেষ কিছুই আমি চাই না’।

রাজশাহীর সন্তান ইমরান শিহানের রয়েছে ফ্যাশন ডিজাইন, গ্রাফিকস ডিজাইন, কালার ম্যানেজমেন্ট ও প্রিন্টিং এবং রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’র ওপর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন  প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি পোশাকের ডিজাইন করেন। তার ডিজাইনকৃত পোশাক দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃতও হয়েছে।

২০১১ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ  ক্রিকেটে তার ডিজাইনকৃত জার্সিতে জাতীয় ক্রিকেট দল প্রতিযোতিতায় অংশ নিয়েছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ওয়ানডে ও টি-২০ সিরিজে জাতীয় দলের জার্সি ও ২০১৩ সালে বিপিএল-এ সিলেট রয়্যালসের জার্সির ডিজাইনও তিনি করেন। এছাড়া, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি ডিজনি আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ফ্রান্সের কোম্পানি সান-সিটি’র জন্য তার ডিজাইনকৃত পোশাক পুরস্কৃত হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৯  
এসএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।