‘কিন্তু আগাম এই পূর্বাভাসকে গুরুত্ব দেয়নি সরকার কর্তৃপক্ষ। বরং একাদশ জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়ার কারণে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আইসিডিডিআরবির এই গবেষণার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন।
‘গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে পরবর্তীতে মশার সহনশীলতা পরীক্ষা না করেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যথাক্রমে ১৪ কোটি এবং ১৭.৩৯ কোটি টাকার পুনরায় একই কীটনাশক (পারমিথ্রিন) কেনে। এছাড়া পরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ডেঙ্গুর ভয়াবহতাকে গুরুত্ব না দিয়ে সিটি করপোরেশনসহ সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি এটাকেও গুজব বলে অভিহিত করেন। একইসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেন। ’
বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য দেন বক্তরা। রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে এডিস মশা তথা ডেঙ্গু নিয়ে আয়োজন হয় সংবাদ সম্মেলনটির। চলতি বছরের ২০ আগস্ট থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে এ তথ্য বের করে আনে টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের সভাপতিত্বে এডিস মশা নিয়ে গবেষণার মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ ও পলিসি বিভাগের দুই ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন এবং মো. মোস্তফা কামাল।
টিআইবি বলছে, জাতীয় পর্যায়ে রোগ সংক্রমক কীট নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল নেই। রোগ সংক্রামক কীটের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বৃদ্ধি করার ওপর জাতীয় কৌশল তৈরি করার উদ্যোগ ২০১৭ সালের নেওয়া হলেও তা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনেরও কোনো ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা নেই। যে কারণে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই অধিক আক্রান্ত এলাকা চিহ্নিত করেও সেখানে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা বিবেচনা করেছে। তাও ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মধ্যে মাত্র ৪১টির তথ্য সংকলন করেছে। অথচ ঢাকায় শুধু বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬ শতাধিক। আর ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। আবার ডেঙ্গু পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়নি; যাদের তথ্য সংকলন করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সরকার ডেঙ্গু পরিস্থিতির মাত্রা কম দেখানোর লক্ষ্যে মাত্র কয়েক হাসপাতালের খণ্ডিত পরিসংখ্যান দেখিয়েছে। এছাড়া এডিস মশার উৎস ধ্বংস বা এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি (পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জৈবিক ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ এবং যান্ত্রিক পদ্ধতি) থাকলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন শুধু রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেক্ষেত্রেও রয়েছে ত্রুটি। কেননা, সিটি করপোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অ্যাডাল্টিসাইড নির্ভর। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাডাল্টিসাইড (পূর্ণবয়স্ক মশা নিধন) ৩০ শতাংশ এবং লার্ভিসাইড (মশার শূককীট নিধন) ৮০ শতাংশ কার্যকর।
টিআইবির মতে, দুই সিটির মশা নিধন কার্যক্রম এ রকম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে এমন কার্যক্রম মানুষের নজরে বেশি পড়ে। একইসঙ্গে এই কার্যক্রমে কেনার সুযোগ বেশি। আর এ সুযোগেই দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশা নিধনের জন্য যে ওষুধকে অকার্যকর বলে বাতিল করেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সেটাকে পুনরায় কিনে ব্যবহার করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, কীটনাশক ও উপকরণ কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে। প্রত্যেক অর্থবছরের শুরুতে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বা রাজস্ব বাজেটের অধীনে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার বিধান থাকলেও তা করা হয় না। আবার পরিকল্পনা না থাকায় বা ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কয়েকমাস কীটনাশক মজুদ শূন্য ছিল।
এদিকে, দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতেও ছিল ঝামেলা। ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে না গিয়ে সরাসরি কার্যাদেশ দেয়। ওদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন উদ্ভিদ সংরক্ষণের উইন এ অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কীটনাশক কিনেছে।
এছাড়া সিটি করপোরেশনের অকার্যকর কার্যক্রম রয়েছে উল্লেখ করে টিআইবি জানায়, হোল্ডিং করদাতাদের জন্য অ্যারোসল ক্রয়, এডিস মশার অ্যাপস তৈরি এবং গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য লোক দেখানো সড়কের বর্জ্য পরিষ্কার এবং ফগিং করার মতো অকার্যকর কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সিটি করপোরেশন দুটি। কেননা, হোল্ডিং করদাতারা নিজেরাই অ্যারোসল ক্রয়ের সক্ষমতা রাখে। তাই সিটি করপোরেশনে গিয়ে অ্যারোসল সংগ্রহের কোনো আগ্রহ তাদের থাকার কথা নয়। এছাড়া অ্যাপসটিতেও ছিল অসংখ্য জটিলতা।
সর্বোপরি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সব অংশীজন বা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতার অভাব ছিল বলে উল্লেখ করে টিআইবি।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৯
এমএএম/টিএ