দেশজুড়ে প্রতিদিনই সমাধান মিলছে কোনো না কোনো মামলার। এর সবটা তো আর জানা যায় না।
সম্প্রতি এমনই এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রহস্য জানিয়েছেন পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার। বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে তুলে ধরেছেন টানটান উত্তেজনাপূর্ণ আর হৃদয় বিদারক এক হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা।
বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো:
খুব ভোরে পীরগাছার অন্নদানগর রেললাইনের সুকানপুকুর রেলব্রিজের কাছে হাত-পা-মাথা বিচ্ছিন্ন কাটাছেঁড়া একটি মরদেহের উপস্থিতি সবাইকে হতবাক করে। গ্রামের মানুষ রেললাইনের ওপর এরূপ দুর্ঘটনা দেখতে মোটেই অভ্যস্ত নয়। ঘটনা দেখার জন্য উৎসুক লোকের জমায়েত বাড়তে থাকে। কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারে না, মরদেহটি কার বা কোথা থেকে এসেছিল?
রেলব্রিজ থেকে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে তাম্বলপুর বাজার। কাউনিয়া সান্তাহার রেললাইনটি এ বাজারটি স্পর্শ করে গিয়েছে।
২০১৪ সালে টি-২০ বিশ্বকাপ সারা বাংলাদেশকে মাতিয়েছে। তাম্বুলপুরই বা বাদ থাকবে কেন? নিকটবর্তী সাধু সোনারায় গ্রামের আল আমিন নয়নের বাবা মো. রফিকুল ইসলাম স্থানীয় মুদি দোকানদার। ৬ এপ্রিল ছিল সম্ভবত বিশ্বকাপের শেষ দিন। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় নয়ন মাকে বলে বাজারের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে খেলা দেখতে যায়। মোটামুটি ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত সুদর্শন ছেলেটি গাইবান্ধা সরকারি কলেজের ইতিহাসের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজের ছুটি পেয়েই এক সপ্তাহ আগে বাড়িতে এসেছে। প্রতিদিন ক্রিকেট খেলা দেখে রাত ১০টার মধ্যে বাড়ি ফেরে। সেদিনও ফেরার কথা। গ্রামে রাত নামে ঝুপ করে। ছেলেটি ফিরে না আসায় বাবা-মার উদ্বেগও বাড়ে ক্রমান্বয়ে। সময় গড়িয়ে যায়। পরদিন বেলা ১১টার সময় রেল দুর্ঘটনার কথা কানে আসায় উৎকণ্ঠিত বাবা তড়িঘড়ি করে ছোটেন সুকান পুকুর রেলব্রিজের দিকে।
রেললাইনের ওপর দুর্ঘটনা। নিয়ম অনুযায়ী এসব দুর্ঘটনায় মরদেহের আইনি নিষ্পত্তি বর্তায় রেল পুলিশের ওপর। ততক্ষণে বোনারপাড়া রেল থানা থেকে পুলিশও এসে গেছে। মো. রফিকুল ইসলামের গগনভেদী আহাজারির মধ্যেই চলতে থাকে পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির কাজ। বাংলাদেশে কেউ যদি দুর্ঘটনায় মারা যা, তাহলে আপনজনেরা মৃতের আর ময়নাতদন্ত করাতে চায় না। তারা মনে করে, ডাক্তারদের এ কাটাছেঁড়া মুর্দার আত্মার শুধু কষ্টই বাড়ায়! সবার পরামর্শে ময়নাতদন্ত না করে পুত্রশোকে উদভ্রান্ত এক পিতা কাঁধে নিয়ে চললেন তার একমাত্র উত্তরাধিকারীকে।
মধ্যবয়সী এ দম্পতির শোক দেখার আর কেউ নেই। সপ্তাহ না যেতেই একদিন হাওয়ায় গুঞ্জন শোনা যায়, ফকিরপাড়ার এক মেয়ের সঙ্গে তার ছেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের এ ফকিরেরা ধনে-জনে-মানে বলীয়ান। শোকাতুর পিতা রফিকুলের মন মানে না- কেন তার বাধ্য ছেলেটি বাড়িতে না এসে উল্টো দিকের রেললাইনে এত দূরে চলে গেল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই একদিন সোজা চলে গেলেন ৬০ কিলোমিটার দূরের বোনারপাড়া রেল থানায়। কিন্তু, ছেলের হাতের মোয়ার মতো চাইলেই তো থানায় মামলা করা যায় না- যেখানে সবাই জানে ঘটনাটি দুর্ঘটনা! একই কারণে গ্রামের কাউকে সঙ্গেও পেলেন না এ দুর্ভাগা পিতা। তিনি আদালতের শরণাপন্ন হলেন।
আদালতের নির্দেশে খুনের মামলা হলো। কিন্তু মরদেহের তো ময়নাতদন্ত হয়নি। সুতরাং, ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশ উত্তোলন করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে পাঠাতে হলো। তারাও মতামত দিলেন- হ্যাঁ, ছেলেটি রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আর তো সংশয় নেই, তাই পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়- FRMF (Final Report Mistake of Fact) হিসেবে। নয়নকে কেউ খুন করেনি। সোজা বাংলায় ‘ঘটনার ভুল বোঝাবুঝি’। কিন্তু, পিতা মো. রফিকুল ইসলাম মানলেন না, না-রাজি দিলেন আদালতে।
পাক্কা আড়াই বছর আগের ঘটনা। পিবিআই রংপুর ইউনিট ইনচার্জ মো. শহিদুল্লাহ কাওছারের নেতৃত্বে টিম বসেছে মামলার ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণে। মরদেহের একটা ছবি ছাড়া কোনো কিছুই কাজে লাগে না। কারণ, সবাই দুর্ঘটনার পক্ষে। ছবিটি বড় করে বিশ্লেষণ করতেই দেখা গেলো, বুকের বাম পাশে একটা চিকন গভীর ক্ষত। প্রতিবেদনে এ ক্ষত সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। রেল দুর্ঘটনায় তো এমন ক্ষত থাকার কথা না! তদন্তকারী কর্মকর্তা খোঁজার চেষ্টা করেন, সেই সময়ে কারা কারা ক্রিকেট খেলা দেখেছিল, কে কে নয়নের পাশে বসেছিল ও সবশেষ তাকে কোথায় দেখা গিয়েছিল।
দীর্ঘ সময়ের স্মৃতি হাতড়ে তারা যতটুকু তথ্য দেয়, তার ভিত্তিতে নয়নের বন্ধু আশিকুর রহমান তুষারকে নিয়ে আসা হয়। তুষারের কথামতো নিয়ে আসা হয় জুয়েল মিয়াকে; সে ঐ মেয়েটির বৈমাত্রেয় ভাই। জুয়েল মিয়া আদালতে স্বীকার করে, বিশ্বকাপের সেদিন ছিল চাঁদনি রাত। খেলা শেষে তুষার, আল আমিন নয়নকে বলে, সেই মেয়েটি তৎক্ষণাৎ তাকে দেখা করতে বলেছে। বন্ধুর কথায় সরল বিশ্বাসে নয়ন তুষারের সঙ্গেই মেয়েটির বাড়িতে যায়। উঠানে গিয়েই দেখে, সেখানে তার অপেক্ষায় আছে মেয়েটির ভাই মুকুল মিয়াসহ চাচাত ও বৈমাত্রেয় ভাই জুয়েল, মনির ও রাঙ্গা। মুকুল নয়নসহ সবাইকে মাঠে ‘হাওয়া খাওয়া’র প্রস্তাব দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা হাওয়া খাওয়ার জন্য নয়নকে নিয়ে রওনা হয়। সারাপথ মুকুল নয়নের হাত ধরে গল্প করে। তারা খোশগল্প করে আর সামনে চলে। ফকিরপাড়ার পরেই ধানক্ষেত, ধানক্ষেতের মধ্যে একটি কালভার্ট। কালভার্টই ছিল নয়নের শেষ গন্তব্য।
হঠাৎ মুকুল তার লুঙ্গির মধ্য থেকে একটি ছুরি বের করে নয়নের বুকের বাম পাশে হৃৎপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দেয়। নয়ন মাটিতে পড়ে যায়। একজন মুখ চেপে ধরে, অন্যরা পা ও হাত। চলতে থাকে এলোপাতাড়ি ছুরির আঘাত। কালভার্টের পাশেই লুকানো ছিল একটি বস্তা, কোদাল, ভ্যানগাড়ি ও দড়ি। খুনিরা মৃত্যু নিশ্চিত করার পর নয়নকে বস্তায় ঢুকিয়ে ভ্যানগাড়িতে ওঠায়। কোদাল দিয়ে মাটির রক্ত পরিষ্কার করে কালভার্টের নিচে ফেলে দেয়- যেন ভাগের মা গঙ্গা সব পাপ মুছে নেবে। কিছু কচি ধান গাছ দিয়ে জায়গাটি ঢেকে দিয়ে খুনিরা নিজেরাই ভ্যান চালিয়ে চলে যায় ১০ কিলোমিটার দূরের সুকান পুকুর রেলব্রিজের কাছে। অপেক্ষায় থাকে, কখন ট্রেন আসবে। রাত তখন প্রায় পৌনে ১টা। নির্ধারিত সময়ে সান্তাহার থেকে লালমনিরহাটগামী ট্রেনের শব্দ শুনেই বস্তা খুলে খুনিরা নয়নের নিথর শরীরটাকে শুইয়ে দেয় রেললাইনের উপর। এ খুনিরাই পরদিন সকালে রেলব্রিজে দুর্ঘটনার পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল।
এ মৃত্যুর কয়েকদিন পর মেয়েটিকে সিলেটে নিয়ে এক প্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইতিহাসের ছাত্র আল আমিন নয়ন কোনো ইতিহাস সৃষ্টির জন্য নয়, শুধু হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিল মেয়েটিকে। হতভাগ্য সেই বিদীর্ণ হৃৎপিণ্ডই খুনিদের ঠিকানায় পৌঁছাতে অন্ধকারে আলোর নিশানা ঠিক করে দেয়।
সূত্র: বোনারপাড়া রেলওয়ে থানার মামলা নম্বর-০২, তারিখ: ১৪/০৪/২০১৪
ধারা-৩০২/২০১/৩৪ দণ্ডবিধি।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯
একে