মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি তদন্তকারী দল। ঘটনাটি তদন্তের জন্য ওই প্রতিনিধি দলটি বতর্মানে রাজশাহীতেই অবস্থান করছেন।
চার সদস্যের প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক আল মাহমুদ ফয়জুল কবীর। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যেই এ কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে আল মাহমুদ ফয়জুল কবীর সাংবাদিকদের বলেন, ওই ছাত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টায় রাজশাহীর শাহ মখদুম থানা পুলিশের কোনো গাফিলতি আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে। কারণ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পর ওই ছাত্রী জানিয়েছিলেন, স্বামীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান তিনি।
মঙ্গলবার দুপুরে এজন্যই তারা শাহ মখদুম থানায় যান এবং কমিটির সদস্যরা এ সময় থানার পাশেই থাকা টিটিসি গেটের সামনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রতিনিধি দলটি তদন্ত স্বার্থে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদ রানাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেন।
মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক আরও জানান, তদন্ত চলাকালে তারা রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ ও সিটি কলেজে যান। এ নিয়ে ওই কলেজছাত্রী ও তার স্বামীর শিক্ষক এবং সহপাঠিদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে আবারও কথা বলবেন। এছাড়া ওই ছাত্রীর সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক কেমন ছিল এবং বিয়ে নিয়ে পারিবারিক কলহ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তাও তদন্ত করে দেখবেন কমিটির সদস্যরা।
এর আগে, গত শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) থানা থেকে বেরিয়ে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন লিজা রহমান (১৮)। ওই দিন রাতে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। ৬৩ শতাংশ দগ্ধ লিজা এখন ঢামেক’র বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন রাজশাহীর দগ্ধ কলেজছাত্রীকে সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে দেখতে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখন পর্যন্ত যতটা জানতে পেরেছি, নিজের ওপর জেদ করেই ওই ছাত্রী এ কাজটি করেছেন। নিজের ওপরে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়েই আগুন দিয়েছের তিনি। কিন্তু এটা কেন? তা তদন্ত করে দেখা হবে। এ জন্য তদন্ত কমিটিও গঠন করা হবে। ঠিক একদিন পরই কমিটি গঠন এবং তাদের রাজশাহীতে পাঠানো হলো।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, লিজার শরীরের ৬৩ শতাংশ দগ্ধ হয়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
‘সাধারণত এ ধরনের দগ্ধরা রিকোভারি করে না। আবার অনেক দেরি করেও বার্ন ইউনিটে আনা হয়েছে। দুই ঘণ্টার মধ্যে আনলে চিকিৎসা ভালো দেওয়া সম্ভব। তবুও আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি থাকছে না, যোগ করেন তিনি।
এর আগে, গত শনিবার দুপুরে রাজশাহীর শাহ মখদুম থানার অদূরে নিজের গায়ে আগুন দেয় লিজা রহমান নামে ওই কলেজছাত্রী। পরে ওইদিন রাতে তাকে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করে পুলিশ।
লিজা রাজশাহীর মহিলা কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি রংপুরের গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে। তার বাবার নাম মো. আলম মিয়া।
ঢামেক হাসপাতালে থাকা তার বাবা আলম বাংলানিউজকে বলেন, মেয়ের আত্মহত্যা চেষ্টার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন তিনি। তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে রানীকে বিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, লিজার যখন তিন মাস তখন তার মা মারা যান। তখন লিজাকে একই গ্রামের আব্দুল লতিফের কাছে দত্তক দেন। সেখানেই বড় বেড়ে ওঠেন লিজা।
লতিফের এক ছেলে রয়েছে। তার নাম শিহাব আহমেদ। তিনিও বোনের সঙ্গে হাসপাতালে এসেছেন। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, স্থানীয় স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর লিজাকে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি করা হয়। ওই কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় দ্বিতীয়বর্ষে পড়েন তিনি।
শিহাব বলেন, সেখানে থাকাকালেই রাজশাহী সিটি কলেজের ছাত্র সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে লিজার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে নাচোল উপজেলার খান্দুরা গ্রামে। পরিবারকে না জানিয়েই তারা চলতি বছরের জানুয়ারিতে গাইবান্ধা কোর্টে বিয়ে করেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এরপর বাসা ভাড়া নিয়ে রাজশাহীতেই ছিলেন তারা। কিন্তু বিষয়টা জানাজানি হলে বেঁকে বসেন ছেলের পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় ভেঙে পড়েন লিজা। ’
শিহাব বলেন, তাদের বাবা আব্দুল লতিফ বর্তমানে মাদক মামলায় কারাগারে। আর কয়েক দফা সাখাওয়াতের বাড়ি গেলে লিজাকে তারা তাড়িয়ে দেন। সাখাওয়াত কিছুদিন লিজার পক্ষে থাকলেও পরিবারের চাপে সেও দূরে সরে যাচ্ছেন। সেই দুঃখে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন লিজা।
এদিকে,রাজশাহী মহানগর পুলিশের শাহ মখদুম জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) হেমায়েতুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বিয়ে করার পর তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেনে নিচ্ছে না, এমন অভিযোগে লিজা থানায় মামলা করতে এসেছিলেন। এর আগেও দু’বার বিয়ে হয়েছে তার। সেগুলোও বিচ্ছেদ ঘটেছে। এসব বিষয় শুনে তাকে থানার পাশে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু কিছুক্ষণ পর বাইরে থেকে ঘুরে আসার কথা বলে সেন্টারের অদূরে ব্যাগে থাকা বোতলের কেরোসিন শরীরে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন তিনি। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ’
বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, কারো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৯
এমএ/এসআরএস