বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) বেলা তিনটার দিকে এই রায় ঘোষণা শুরু হয়। বিপুল সংখ্যক আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীর উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ।
বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা, সাক্ষীদের জবানবন্দির সারাংশ আদালতে তুলে ধরেন বিচারক। তিনি বলেন, এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা মার্কেটের দোকানে কাপড় সেলাই করতে গেলে দোকানে রিশা ও তার মায়ের নম্বর দিয়ে আসেন। সেই সূত্রে মায়ের নম্বরে ওবায়দুল মাঝে মাঝে ফোন দিতো। তখন দুই একবার কথা হয় রিশার সাথেও। তবে যখন সে বুঝতে পারে যে, রিশা তাকে পছন্দ করছে না। তখন হাতিরপুল মোতালেব প্লাজার একটি দোকান থেকে তরকারি কাটার কথা বলে একটি ছুরি কিনে। ১২০টাকা দামে কেনা সেই ছুরি দিয়ে স্কুলের সামনে ওভারব্রিজে ঠান্ডা মাথায় পেটে ও হাতে আঘাত করে রিশাকে হত্যা করে সে। এরপর সে ঢাকা থেকে পালিয়ে গেলে নীলফামারী থেকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতারের পর সে দোষ স্বীকার করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেয়।
রাষ্ট্রপক্ষের ২২ জন সাক্ষীদের দেয়া জবানবন্দির সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরে বিচারক বলেন, এই ঘটনা তার ওই স্কুলের দুই শিক্ষার্থী মুহতারিফ রহমান ও আল আমিন শেখ দেখে। তারা ওবায়দুলকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলে ছুরি উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর তার সহপাঠী ও শিক্ষকরা তাকে প্রথমে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানেই চারদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর রিশা মারা যান।
চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় দায়িত্বরত চিকিৎসকের কাছে সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী‘মৃত্যুকালীন ঘোষণা’ দেন রিশা। যেখানে হত্যাকাণ্ডের জন্য ওবায়দুলকে দায়ী করা হয়। পরে সেগুনবাগিচায় ইটের স্তুপ থেকে ছুরিটি উদ্ধার করা হয়। পুরো বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করে প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী, ফুটওভারব্রিজের নিকটবর্তী চা দোকানদার, চিকিৎসক, ছুরির দোকানী ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা সাক্ষী দিয়েছেন।
এমতাবস্থায় সাক্ষ্যের বিষয়ে আসামিপক্ষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষ্য ও মৃত্যুকালীন ঘোষণা নিয়ে যেসব আপত্তি উত্থাপন করে আদালত তা খারিজ করে ওবায়দুলকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন।
সবশেষ আদালত বলেন, একজন ব্যবসায়ীর মেয়ে রিশার মতো একজন ছাত্রীকে দর্জির দোকানের কাটিং মাস্টার ওবায়দুলের ভালোবাসা অসমনীয় নয়। ভালোবাসার অধিকার সবার আছে। তবে সেই ভালোবাসা সহিংসতায় রূপ নিয়ে যাতে জীবন দিতে না হয়। দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলো। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়।
রায় ঘোষণার আগেই রিশার সহপাঠী, শিক্ষক ও স্বজনরা আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হন। রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তার সহপাঠীরা উল্লাস প্রকাশ করেন।
রায়ের পর রিশার বাবা ব্যবসায়ী রমজান হোসেন, মা তানিয়া হোসেন ও উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের প্রিন্সিপাল আবুল হোসেন পৃথকভাবে পথকভাবে বাংলানিউজের কাছে নিজেদের সন্তোষের কথা জানান। তারা বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আশা করছি হাইকোর্টেও রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত তা কার্যকর হবে। ঘাতকের শাস্তি কার্যকর হলেই রিশার আত্মা পুরোপুরি শান্তি পাবে।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী এখন মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) মামলাটি হাইকোর্ট বিভাগে যাবে। আসামি আপিল করলে ডেথ রেফারেন্স ও সেই আপিল একইসঙ্গে হাইকোর্টে শুনানি হবে।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু ও অতিরিক্ত পিপি তাপস কুমার বিশ্বাস।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট দুপুরে স্কুলের সামনে ফুটওভার ব্রিজে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। চারদিন পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। হামলার দিনই রিশার মা তানিয়া বেগম রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় এবং দণ্ডবিধির ৩২৪/৩২৬/৩০৭ ধারায় হত্যাচেষ্টা ও গুরুতর আঘাতের অভিযোগে মামলা করেন। রিশা মারা যাওয়ার পর এটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৯
কেআই/এমএমএস