বেড়েই চলেছে অসাধু ব্যক্তি আর দালালের দৌরাত্ম। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আর সহযোগিতার কাজে যে সব আনসার কর্মরত তার মধ্যেই রয়েছে ভূত! আনসাররা কমিশনের ভিত্তিতে দালালদের কাছে সেবা গ্রহীতাদের পাঠানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আসার পর ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তবে দালাল বন্ধের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও থামেনি দালালদের কার্যক্রম। দালালরা তাদের কৌশল পাল্টেছে মাত্র। তবে কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিস শতভাগ দালালমুক্ত বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ।
কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে একাধিক দালাল চক্র স্বক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে তার সত্যতাও মিলেছে।
সম্প্রতি দিনব্যাপী কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্র্ট অফিসে ঘুরে দেখা মেলে দালালচক্রের কার্যক্রম।
রোববার সকাল ১০টা। কুষ্টিয়া বাস টার্মিনালের পশ্চিমে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে দুদক কার্যালয়। সাধারণ মানুষ মনে করে, যেখানে দুদকের কার্যালয় সেখানকার পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতির কোনো সুযোগই নেই। দালালও হয়তো নেই। তবে বাস্তবচিত্র পুরোটাই উল্টো। এ যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকার।
পাসপোর্ট অফিসে ঢুকতেই দেখা গেলো আব্দুর রহমান নামে একজন ব্যক্তি চেয়ার নিয়ে বসে আছে। জিজ্ঞাসা করলেন পাসপোর্ট করবেন? মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম। আব্দুর রহমান বললেন, উপরে না গিয়ে সাইডে আসেন দেখছি... কী করা যায়। কথা শুনে মনে হলো লোকটা এ অফিসেই কর্মরত। পাসপোর্ট করা যেন তার হাতের কাজ। বললেন, সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে, পরে বিস্তারিত জানাবো। তবে দিলেন একটা মোবাইল নম্বর। কিছুক্ষণ পরে দেখা যায় আব্দুর রহমান আনসার সদস্যের পোশাক পরে ডিউটি করছেন। দেখে আবার ডাকলেন। নতুন যারা পাসপোর্ট করতে আসছেন প্রায় সবাইকেই জিজ্ঞাসা করছেন তিনি। দিচ্ছেন দালালের কাছে যাওয়ার পরামর্শও। আবারো কাছে ডেকে আব্দুর রহমান বললেন, ভাই আপনি সহজে পাসপোর্ট করতে চাইলে আমার সঙ্গে আসুন।
এরই মধ্যে আরো দু’জন নতুন পাসপোর্ট করতে এসেছেন। তাদেরও পরামর্শ দিলো- ‘একজন আছে, যিনি সহজেই পাসপোর্ট করে দিতে পারে’। তবে শর্ত একটাই টাকা লাগবে অতিরিক্ত। তারপর আব্দুর রহমান নিজেই ফোন করে ডাকলেন শাহীন নামে এক দালালকে। শাহীন এলেন পাসপোর্ট অফিসের ভেতর।
শাহীন বলেন, টাকা-পয়সা-কাগজপত্র আমাকে দেবেন। আপনি শুধু আঙ্গুলের ছাপ আর ছবি ওঠাবেন। সব আমি সামলে নেব। প্রয়োজনে আমরা ঢাকায় গিয়ে দ্রুত পাসপোর্ট প্রিন্ট করে দিতে পারবো। মোট ৮ হাজার ৩শ টাকার মতো খরচ হবে। দিনে-দিনে আঙ্গুলের ছাপ আর ছবি তুলতে হলে আরও ১৩০০ টাকা বেশি লাগবে।
আব্দুর রহমান বলেন, অল্পসময়ে সহজেই পাসপোর্ট করতে হলে আমাদের হাতে লোক আছে। টাকা দেবেন কাজ করে দেবো। আর টাকা দিলেই নিশ্চিন্তে থাকবেন কাজ হবে। দরকার হয় তিন দিনে ঢাকা থেকে পাসপোর্ট করে দেবো, তবে টাকা বেশি লাগবে।
আরো কম টাকায় করতে হলে আরেক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বললেন আব্দুর রহিম। তার নাম মিল্টন। পাসপোর্ট অফিসের সামনেই তার দোকান ‘মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজ’।
মিল্টন জানান, নতুন পাসপোর্ট করতে খরচ হবে (সাধারণ) পাসপোর্ট ফি ৩ হাজার ৪৫০ টাকা, সঙ্গে ফরম লেখা বাবদ ৩০০ টাকা, আর যদি একদিনে ছবি ও আঙ্গুলের ছাপ দিতে চান তাহলে আরো ২০০ টাকা। আর যদি পুরো প্যাকেজ (কম সময়ে পাসপোর্ট, একদিনেই আঙ্গুলের ছাপ, ছবি ওঠানো, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ফরম লেখা) তাহলে লাগবে ৬ হাজার টাকা। তা না হলে এটা ভুল, ওটা ভুল, অন্যদিন আসেন নানা ঝামেলা আছেই।
কী কী কাগজপত্র লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুধু ভোটার আইডি কার্ড আনবেন। তাছড়া যা প্রয়োজন আমরা দেবো। আপনার ইউনিয়নের প্রত্যয়নপত্রও আমরা দিতে পারবো।
আরেকজন দালাল রাজু একটা পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে করতে বলেন, আমাদের কাছে দিলে একদম নিশ্চিন্ত। কোনো কাজ করা লাগবে না। সব করবে টাকায়। পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে সমস্যা হবে না। আপনি আসবেন আর আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ছবি উঠিয়ে যাবেন।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা থেকে নতুন পাসপোর্ট ডেলিভারি নিতে এসেছিলো সোহান নামের একজন।
সোহান জানান, গত ২৪ সেপ্টেম্বর আমার পাসপোর্ট ডেলিভারি দেওয়ার কথা। ২৪ তারিখ এসে পাসপোর্ট পাইনি। ২৯ সেপ্টেম্বর এসেছিলাম আবার। সেদিনও পাইনি। আবারো ০৩ অক্টোবর এসেছি। জানালো- এখনো ঢাকা থেকে পাসপোর্ট প্রিন্ট হয়ে আসেনি, আরো সাত দিন পর আসতে হবে।
বহলবাড়ীয়া এলাকার ইব্রাহিম আলী জানান, আমি বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করতে দিয়েছি। গত ২৮ আগস্ট আমার পাসপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া কথা থাকলেও আমি আজও পাসপোর্ট পাইনি। কবে পাবো তার ঠিক নেই, একমাস ধরেই প্রিন্ট হচ্ছে কথাটি শুনে শুনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
এদিকে দালালচক্রের কার্যক্রম বন্ধে একাধিকবার কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অভিযান পরিচালনা করে প্রশাসন ও দুদক।
জানা গেছে, ২০১১ সালে কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসে ডিবি পুলিশের অভিযানে দালালচক্রের ৯ সদস্যকে আটক করে। গত ১৪ জুলাই দুদকের হটলাইনে ফোন দিয়ে দালালদের সম্পর্কে অভিযোগের ভিত্তিতে কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালায় দুদক কর্মকর্তারা। তবে পাসপোর্ট অফিস ও কুষ্টিয়ার দুদক কার্যালয় প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও অভিযানের আগেই পালিয়ে যায় দালালরা। সেদিন কাউকে আটক করতে পারেনি দুদক।
কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ, ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার রশিদ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ফরম জমায় ভোগান্তি, ছবি-আঙ্গুলের ছাপ নিতে ভোগান্তি, বিলম্বে পাসপোর্ট ডেলিভারিসহ নানান অজুহাতে হয়রানি করা হয় সাধারণ গ্রাহকদের। অভিযোগ রয়েছে দালালদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্যসহ ভেতরের কর্মকর্তাদের কিছু লোক জড়িত। দালালদের চক্র অনেক বড়। একাধিক দালালচক্র এখানে কাজ করে। তবে বেশিরভাগেরই এজেন্ট হিসেবে কাজ করে আনসার আব্দুর রহমান।
কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক বজলুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, আমাদের অফিসে কিছু জনবল সংকট রয়েছে। তারপরেও আমরা চেষ্টা করি সবোর্চ্চ সেবা দিতে। জরুরি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ৭ কর্মদিবস এবং সাধারণ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ১৫ কর্মদিবস সময় লাগে। অনেক সময় ঢাকায় প্রিন্টে সমস্যা হলে দেরি হতে পারে।
তিনি দাবি করে বলেন, এই অফিসে কোনো দালাল নেই। কারণ আমরা সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করি। এছাড়া একই ব্যক্তিকে প্রতিদিন আসতেও দেয়া হয় না। এছাড়া সন্দেহভাজন কাউকে অফিসে আমরা ঢুকতে দেইনা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের কুষ্টিয়া কার্যালয়ের লিগ্যাল অফিসার বাসেদ আলী বাংলানিউজকে জানান, অভিযোগ পেলে আমরা অভিযান চালাতে পারি। এছাড়া হটলাইনে অভিযোগ জানালে আমাদের নির্দেশনা এলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবো। আমরা কয়েকদিন পূর্বে অভিযান চালিয়ে এক দালালকে আটক করি। তাকে সতর্ক করি সেই সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়। পরে আর অভিযান চালানো হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৯
এসএইচ