ঢাকা, সোমবার, ২০ মাঘ ১৪৩১, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

এলাকার মাদক-চাঁদাবাজি ‘পাগলা মিজানের’ নিয়ন্ত্রণে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৯
এলাকার মাদক-চাঁদাবাজি ‘পাগলা মিজানের’ নিয়ন্ত্রণে হাবিবুর রহমান মিজান। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে সরকারি সম্মানীর বাইরে কোনো বৈধ আয় নেই হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের। মাসিক সম্মানী হিসেবে মাত্র ৩৬ হাজার টাকা পেলেও নিজে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক। আমেরিকার টেক্সাস ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির পাশাপাশি দেশেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

শুক্রবার (১১ অক্টোর) র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে গ্রেফতারের পর বের হয়ে আসে পাগলা মিজানের একের পর এক অপকর্মের কথা।  

জানা যায়, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের মাদককারবারির গডফাদার তিনি।

এছাড়া, জেনেভা ক্যাম্পের অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনের বিনিময়ে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন পাগলা মিজান। এলাকার বিভিন্ন বাজার, বার্ষিক গরুর হাট এমনকি টেন্ডারবাজিও ছিল পাগলা মিজানের আয়ত্বে।
 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার একটি অংশের সেল্টারদাতা ছিলেন পাগলা মিজান। অর্থের বিনিময়ে মাদককারবারিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছিলেন তিনি। জেনেভা ক্যাম্পে অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা দোকান পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু এ অবৈধ সুবিধার জন্য প্রতি দোকানীকে মাসে ৩০০-৪০০ টাকা দিতে হতো। আর সেই টাকা যেত ক্যাম্পের অলিখিত নিয়ন্ত্রক মিজানের হাতে।
 
এদিকে, রাজধানীর শ্যামলী এলাকার কাঁচাবাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ছিল মিজানের নিয়ন্ত্রণে। এসব বাজারে দোকান বসানোর বিনিময়ে টাকা এবং মাসিক চাঁদা আদায় করতেন মিজানের লোকজন। বার্ষিক গরুর হাট বসানোসহ আড়ংয়ের মাঠে প্রতি সপ্তাহে গাড়ির হাট বসাতেন তিনি।
 
কাউন্সিলর হিসেবে নিয়মিত এলাকার ড্রেন-ফুটপাত মেরামত, মসক নিধন কার্যক্রম, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, মাঠ সংস্কারের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। সরকারি যে কোন কাজের টেন্ডারও ছিল মিজানের হাতে।
 
শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বিকেল থেকে পাগলা মিজানকে সঙ্গে নিয়ে তার বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। এ সময় তার বাসা থেকে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের দু’টি চেক, প্রিমিয়ার ব্যাংকের একটি চেক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের একটি চেক, বেসিক ব্যাংকের একটি চেক, পূবালী ব্যাংকের একটি চেক, ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি চেক, মেসার্স আল মক্কা ‘স’ মিল অ্যান্ড টিম্বার ট্রেডার্সের একটি মানি রিসিট, ছয়টি এফডিআরের স্ক্যানকপি, ডিপোজিট স্লিপ বই দু’টি উদ্ধার করা হয়। যা সর্বমোট সাত কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার চেক ও এফডিআর।
 
এর বাইরেও আমেরিকার টেক্সাসে ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক পাগলা মিজান। র‌্যাবের ধারণা, মাদক চোরাকারবারী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে আয়ের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন তিনি।
 
শনিবার (১২ অক্টোবর) গ্রেফতার পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা (নম্বর-৩১) দায়ের করে র‌্যাব। মামলার এজাহারেও আসামি হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে (৬৩) এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও অবৈধ মাদককারবারির গডফাদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
 
এজাহারে বলা হয়, পাগলা মিজান পেশীশক্তি প্রয়োগ করে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। তিনি অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ভীতি সৃষ্টি করে টেন্ডারবাজি, গরুর হাট দখল, চাঁদাবাজি করে স্বনামে বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বৈভবের মালিক হয়েছেন। তার কাছ থেকে জব্দ করা চেকগুলো ও এফডিআরের অর্থের উৎস তিনি দেখাতে পারেননি এবং এ বিষয়ে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এর ফলে আসামি হাবিবুর রহমান মিজান মানিলন্ডারিং আইন ২০১২ (সংশোধন/২০১৫) ৮/২ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
 
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, ম্যাগজিন, গোলাবারুদ এবং নগদ টাকা উদ্ধারের বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানায় মিজানের বিরুদ্ধে র‌্যাব-৯ বাদী হয়ে পৃথকভাবে অস্ত্র আইনে আরও একটি মামলা দায়ের করেছে। মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের হওয়ায় মামলাটি তদন্ত করবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
 
এতো অভিযোগ সত্ত্বেও পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে এতোদিন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আব্দুল আহাদ বাংলানিউজকে বলেন, ইতোপূর্বে কাউন্সিলর মিজানের বিরুদ্ধে কেউ সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ করেননি।
 
মিজানুর রহমান থেকে হাবিবুর রহমান:

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনীতি জীবনের শুরুতে ফ্রিডম পার্টির নেতা ছিলেন হাবিবুর রহমান মিজান। ১৯৮৯ সালে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন এ হাবিবুর রহমান ও তার ভাই। তবে সে সময় তার নাম ছিল মিজানুর রহমান। সময়ের বিবর্তনে সেই মিজানুর রহমানই নাম পাল্টে হাবিবুর রহমান হয়ে যান। রাজনীতিতেও খোলস পাল্টে ফ্রিডম পার্টি ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগের ব্যানারে সক্রিয় রাজনীতির প্রভাবে ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে স্থানীয়দের কাছে তিনি পাগলা মিজান হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
 
মিজানকে আটকের সময় অভিযানে থাকা র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, শ্রীমঙ্গলে বান্ধবীর বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন পাগলা মিজান। সেখান থেকে সীমান্ত এলাকা হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। আটকের সময় নিজের পরিচয় গোপনের চেষ্টা করেন মিজান। নিজেকে বারবার মিজান বলে অস্বীকার করেন এবং হাবিব বলে পরিচয় দেন।
 
অভিযানের নেতৃত্বে থাকা র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বাংলানিউজকে বলেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানের বিরুদ্ধে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসাসহ সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ রয়েছে। সে সব অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার ভোরে শ্রীমঙ্গলের কলেজ গেট এলাকায় তার এক বান্ধবীর বাসা থেকে মিজানকে গ্রেফতার করা হয়।
 
পরে তদন্তে মাদক-ক্যাসিনো ব্যবসাসহ চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির সব অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার হামলা এবং অতীতে তিনি ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে বলেও জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার।

** টেক্সাস-সিডনিতে বাড়ি, বিপুল অর্থের মালিক 'পাগলা মিজান'!
 
বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৯
পিএম/আরআইএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।