নগরের প্রবেশদ্বার খ্যাত দক্ষিণ সুরমায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় বাস-ট্রাক টার্মিনাল ও রেলস্টেশন, বিভাগীয় দফতরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ফলে উত্তর সুরমার সমধিক গুরুত্ব দক্ষিণ সুরমা।
তথ্য মতে, ব্রিটিশ শাসনামলে নদীর দু’তীরের সেতুবন্ধন গড়ে দিয়েছিল ক্বিন ব্রিজ। ধনুকের ছিলার মতন বাঁকানো ক্বিন ব্রিজ লোহা দিয়ে তৈরি। সুরমার উপর অবস্থিত ব্রিজের নামকরণ হয়েছিল আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল ক্বিন’র নামে। ১৯৩২ থেকে ৩৭ সালে আসাম প্রদেশের গভর্নর ছিলেন মাইকেল ক্বিন। তখন আসামের সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। মাইকেল ক্বিন’র সিলেট সফরে আসাতে সুরমা নদীর উপর ব্রিজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ কারণে ১৯৩৩ সালে রেলওয়ে বিভাগ সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৩৬ সালে ব্রিজটি নির্মাণ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। প্রায় ১১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ ফুট প্রস্থের ব্রিজ নির্মাণে তৎকালীন ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা।
ক্বিন ব্রিজ দিয়ে নগরের প্রবেশদ্বার (উত্তর সুরমা) ব্রিজের ডান পাশে সুরমার তীরে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় ঐতিহাসিক ঘড়িঘর। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পৃত্থিমপাশার জমিদার আলী আহমদ খান তার ছেলে আলী আমজদের নামে ঘড়িঘরটি নির্মাণ করেন। লোহার খুঁটির উপর ঢেউটিন দিয়ে সুউচ্চ গম্বুজ আকৃতির স্থাপত্যশৈলীর ঘড়িঘরটি তখন থেকেই আলী আমজদের ঘড়িঘর নামে পরিচিত। সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে নির্মিত এই ঘড়ির ডায়ামিটার আড়াই ফুট এবং ঘড়ির কাঁটা দুই ফুট লম্বা। ওই সময় ঘড়ির অবাধ প্রচলন ছিল না। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডায়নামাইট দিয়ে ব্রিজের উত্তর পাশের একাংশ প্রাচীন ঘড়িঘরটিও বিধ্বস্ত হয়। স্বাধীনতার পর ক্বিন ব্রিজ কাঠ ও বেইলী পার্টস দিয়ে মেরামত করা হয় ও হালকা যান চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতায় ব্রিজের বিধ্বস্ত অংশটি কংক্রিট দিয়ে পুনঃনির্মাণ করা হয়।
এর আগে দুইবার বড় ধরনের সংস্কার করা হয় ওই ব্রিজে। তৎকালীন সিলেট পৌরসভা আলী আমজদের ঘড়িটিও মেরামতের মাধ্যমে সচল করে। যদিও বছর কয়েক পর ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৮৭ সালে ঘড়িটি মেরামত করে পুনরায় চালু করা হয়। সেই থেকে ইতিহাসের অংশ হয়ে আজো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ঘড়িঘর ও ক্বিন ব্রিজ।
৮৬ বছরের পুরনো ক্বিন ব্রিজ এখনো মানুষ ও যানবাহনের ভার বহন করে চলেছে। যদিও সুরমার উপর শাহজালাল প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং কাজিরবাজার সেতু নির্মাণে যোগাযোগের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে।
এরপরও প্রয়োজনীয়তা ফুরায়নি প্রায় শতবর্ষী ক্বিন ব্রিজটির। অথচ ব্রিজের পানির নিচে থাকা লোহার আর্চে জং ধরে ক্ষয়ে গেছে। যে কারণে সড়ক ও জনপথ সেতুটিতে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখে।
শতবর্ষী ওই ব্রিজকে হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণে বন্ধ গত ১ সেপ্টেম্বর বন্ধ করে দেয় সিলেট সিটি করপোরেশন। কেবল হাঁটা চলার জন্য ব্রিজের দু’পাশে লোহা দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে দেওয়া হয়। তবে সেতুর দুই প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেওয়ায় ব্রিজটি চলে যায় ভাসমান হকারদের দখলে।
তাতে নাখোশ হয় দক্ষিণ সুরমাবাসী। ব্রিজটি খুলে দিতে তারা আন্দোলন অব্যাহত রাখে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড লাগালেও মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) দিনগত রাতে প্রতিবন্ধক তুলে সেতুটি ফের যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ সুরমার তিনটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আজম খান, সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র দেওয়ান তৌফিক বক্স লিপন, তাকবিরুল ইসলাম পিন্টু, মহিলা কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র রোকসানা বেগম শাহনাজ প্রমুখ।
সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণ সুরমাবাসীর পক্ষে মুরব্বিরা ব্রিজটি খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তাছাড়া সামনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষা। বাইরে থেকে আসা আগতরা যেনো কষ্টে না পড়েন। প্রয়োজনে পরবর্তীতে বন্ধ করে দেওয়া হবে। মুরব্বিদের অনুরোধে রিকশা-মোটরসাইকেল, হাতাগাড়ি চলাচলের জন্য ব্রিজটি খুলে দেওয়া হয়েছে। ব্রিজ খুলে দিলেও ইঞ্জিনচালিত কোনো ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে কঠোর থাকতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৯
এনইউ/এএটি