মানিকগঞ্জ: পাকিস্তান ওলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী বাঙালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বলতম অ্যাথলেট শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মিরাজউদ্দিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছেন।
স্বাধীনতার ৪০তম বর্ষে জাতীয়ভাবে তো নয়ই; তার জন্মভূমি মানিকগঞ্জেও আলাদা করে কেউ তাকে স্মরণ করেনি ।
মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামের নামফলকে শহীদ তপনের সঙ্গে যৌথভাবে অঙ্কিত আছে তার নাম ‘শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়াম’। প্রাপ্তি এটুকুই।
প্রবীণেরা মোটামুটি চিনলেও এ প্রজন্মের যারা স্টেডিয়ামে আসেন, তারা মিরাজ নামটাই শুধু জানে। এর বেশি কিছ জানে না। তারা জানে না মিরাজের বর্ণাঢ্য খেলোয়াড় জীবন বা যোদ্ধাজীবনের এক বর্ণও। জানাবার কোনা উদ্যোগও নেই।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাটিকান্দা গ্রামে জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ, স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের সেরা ক্রীড়াবিদ এ.কে.এম.মিরাজউদ্দিন (আলোক)।
মাত্র ১১ বছর বয়সে হারিয়েছিলেন বাবা শরীফ উদ্দিন আহমেদকে। বিধবা মা হাজেরা খাতুন তাকে তিল তিল করে বড় করেছেন মানুষের মতো করে।
মিরাজের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হরিরামপুরের লেছরাগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। প্রাইমারি পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন হরিরামপুরে পাটগ্রাম অনাথবন্ধু হাইস্কুলে। এখান থেকে অষ্টম শ্রেণী পাশ করে ভর্তি হন ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটে। এরপর জগন্নাথ কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অসাধারণ গড়নের সুদর্শন মিরাজের ক্রীড়াখ্যাতি ঝলসে উঠেছিল স্কুল জীবনেই। তার প্রিয় ইভেন্ট ছিল পোলভল্ট, হার্ডলস এবং লং জাম্প।
১৯৬৩ সালে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে এ তিনটি ইভেন্টে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিলেন মিরাজ।
১৯৬৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি।
১৯৬৫ সালে আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ঢাকার জগন্নাথ কলেজের হয়ে ১১০মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট এবং লং জাম্পে নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন।
১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ১০ম পাকিস্তান ওলিম্পিকে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন মিরাজ। পোলভল্টে পাকিস্তান ওলিম্পিক রেকর্ড করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি খেলোয়াড়দের মধ্যে মিরাজই একমাত্র স্বর্ণপদক ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বিস্ময়ের বিষয় ছিল মিরাজ ১২ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা অতিক্রম করেছিলেন বাঁশের পোল (লম্বা লগা) দিয়ে। সে সময়ের পাকিস্তান দলের অ্যাথলেটিক্স কোচ জার্মানির হফম্যান বলেছিলেন ‘এই ছেলেটি একটি ফাইবার পোল পেলে এশিয়ান গেমসের রেকর্ডও ভাংতে পারবে’।
বাঁশের পোল দিয়ে মিরাজের গড়া সেই রেকর্ড বহুবছর কেউ ভাঙতে পারেনি। ১৯৭০ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এ তিনটি ইভেন্টে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিলেন মিরাজউদ্দিন। একই বছর করাচি হকি ক্লাব মাঠে অনুষ্ঠিত ১২তম পাকিস্তান জাতীয় গেমসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়াদলের পতাকা হাতে মার্চপাস্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাদের সেরা অ্যাথলেট হিসেবে মিরাজকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
শুধু ক্রীড়াঙ্গনেই নিজেকে আটকে রাখেননি মিরাজ। অসাধারণ জনপ্রিয়তা আর বন্ধু বাৎসল্য দিয়ে রাজনীতির মাঠও জয় করছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিরাজউদ্দিন ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে মিউনিখ ওলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সে সৌভাগ্য তার হয়নি। ২৫ মার্চের কালোরাত্রি সব কিছু উল্টে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসহ শহরে অলিগলির নির্বিচার গণহত্যায় জ্বলে ওঠে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড কাপানো মিরাজের বিদ্রোহী আত্মা।
কালমাত্র বিলম্ব না করে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে আসেন হরিরামপুর গ্রামে মায়ের কাছে। গ্রামে বসে সংগঠিত করতে থাকেন তরুণদের। মুক্তির লড়াই করতে হবে...।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিক। খবর আসে মানিকগঞ্জ ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হরিরামপুরে ঘাঁটি গেড়েছেন মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল হালিম চৌধুরী। বিধবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন হালিমের কাছে হাজির হয়ে যান মিরাজ।
পোলভল্টের বাঁশের পোল ধরা হাতে আঁকড়ে ধরেন অস্ত্র। একটির পর একটি গেরিলা যুদ্ধ। আসতে থাকে জয়। যুদ্ধকালীল কমান্ডার তবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ঘটে ঐতিহাসিক গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ।
টাইগার লোকমান, নবাবগঞ্জের মনসুর আর মিরাজদের মরণপণ হামলায় নিহত হয় ৮১ জন খান সেনা।
২ নভেম্বর ১৯৭১। যুদ্ধজয়ের নেশায় উন্মত্ত মিরাজদের উপর দায়িত্ব পড়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বানিয়াজুরি ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার। রাতের আঁধারে শুরু হয় অপারেশন। কিন্তু বিধিবাম। ব্রিজে ডিনামাইট বসাতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান মিরাজ।
তাকে চিনতে দেরি হয়নি হানাদারদের। বন্দী মিরাজকে মানিকগঞ্জের ক্যাম্পে না নিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার আর্মি হেড কোয়ার্টারে। এখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে নির্মম নির্যাতন। হাজারও নির্যাতনের মুখে মিরাজের কাছ থেকে সহযোদ্ধাদের খবর বের করতে পারেনি তারা। এরই এক পর্যায়ে আহত মিরাজকে দেখানো হয় পাকিস্তান টেলিভিশনে। পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় দুষ্কৃতি হিসেবে। জোর করে বলানো অনেক কথা। তারপর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
১৭ ডিসেম্বর স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল, স্বর্ণরাঙা সকালে মিরাজের ভাইসহ পরিবারের সবাই ছুটে যান কেন্দ্রীয় কারাগারে। কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষ তাদের কাছে নির্মম সত্যটি জানিয়ে দেন-মিরাজ তাদের কাছে নেই।
৮ ডিসেম্বর সকালে আলবদর বাহিনীর পরিচালক মেজর মোস্তাক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিরাজকে মুক্ত করে পাকবাহিনীর জিপে করে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আজও তার কোনো খোঁজ মেলেনি। আলবদর বাহিনী ক্রীড়াঙ্গনের এই নক্ষত্রকে চিনতো বলেই তাকে নিভিয়ে দেওয়ার কথা ভুলেনি।
পাকিস্তান আমলে মিরাজের মত উজ্জ্বল নক্ষত্র ক্রীড়াঙ্গনে খুব বেশি ছিল না। যাকে নিয়ে ৭ কোটি বাঙালি গর্ব করতে পারতো। সেই গর্বের মিরাজ আজ তার রক্তে স্বাধীন ভূমিতেই বিস্মৃত এক অতীত। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াবিদ হিসেবে বাংলাদেশ মিরাজকে যেমন স্মরণে রাখেনি, তেমনি ভুলতে বসেছে তার নিজ জেলা মানিকগঞ্জও।
মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামের নামকরণ করেই যেন সব দায় শেষ। মিরাজকে নিয়ে একটি স্মরণসভা বা বছরান্তে একটি দোয়া মাহফিলও হয়নি গত তিন যুগে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১১