শিরীন আখতার বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংগ্রামী একটি নাম। স্কুল জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
বাংলানিউজ: নারীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার কাজ করতে কীভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন?
শিরিন আখতার: আমি যখন ছাত্র রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছি, শ্রমিক রাজনীতি করবো বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। তখন আমি দেখলাম বাংলাদেশের নারীরা প্রচণ্ডভাবে অবহেলিত। দেশের নারীদের জন্য তেমন কোনো কণ্ঠস্বর নেই। তারা কণ্ঠহীন। নারী নেতৃত্বও নেই। এসব দেখে আমি সিদ্ধান্ত নেই যে আমি নারীদের সংগঠিত করবো। এ কারণেই ১৯৯১ সালে 'কর্মজীবী নারী' প্রতিষ্ঠা করি। বর্তমানে আমরা বাংলাদেশের লাখ লাখ নারী শ্রমিক নিয়ে কাজ করছি।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শিরিন আখতার: নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের সূচনা হয় ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। এদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে মজুরি বৈষম্য, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা লড়াই করতে রাস্তায় নেমেছিল। বাংলাদেশের নারীরা এখনও প্রতিনিয়ত প্রতিদিন, ঘরে ও বাইরে লড়াই-সংগ্রাম করে চলেছে।
৮ মার্চের আন্দোলন থেকে পরবর্তী সময়ে নারীদের স্বাধীনতা, সমঅধিকার, ভোটের অধিকার, সমান অধিকারের বিষয় সামনে এসেছে। আজকে বাংলাদেশে নারীর মর্যাদা এবং সমঅধিকার নিশ্চিত করবার জন্য ৮ মার্চ যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হয়।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের নারীর অগ্রগতিতে কোন কোন বিষয়কে অন্তরায় মনে করেন?
শিরিন আখতার: নারীর চলার পথে কেউ যেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে পারে সে বিষয়টি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। ধর্মীয় কোনো অনুশাসন বা ফতোয়া দিয়ে নারীকে যেন ঘরে আবদ্ধ করে না রাখা হয়। ‘তেঁতুল হুজুররা’ বারবার বলছে, মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করা উচিত নয়। বর্তমান সময়েও আমাদেরকে এমন কথা শুনতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজের নামেও নারী শিক্ষা ও অগ্রগতির বিরুদ্ধে বলা হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী শিক্ষা, অধিকার, অগ্রগতি, কর্মক্ষেত্রকে অনুশাসনের মধ্যে আনা যাবে না।
নারী শিক্ষার হার বর্তমানে অনেক বেড়েছে। শিক্ষার দিক থেকে বর্তমানে নারী এবং পুরুষ প্রায় সমান অবস্থানে রয়েছে। তারপরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের ওপর নানা রকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। যার উদাহরণ ফেনী জেলার সোনাগাজীর নুসরাত হত্যা।
অনেকেই নারীর পোশাকের শালীনতার কথা বলেন। নারীর পোশাকের স্বাধীনতার কথা বলেন। কিন্তু আমরা চোখের সামনেইতো দেখলাম নুসরাত এবং তনুকে। তারা দুজনেই হিজাব পরতেন। আমরা তাদেরকেও রক্ষা করতে পারিনি। সুতরাং মনের পশুটাকে বলি দিতে হবে। মনের ভেতরে পশুটার কবর রচনা করতে হবে।
আমাদের সমাজ এখনো শ্রেণীবিভক্ত রয়েছে। একইসঙ্গে সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা বিদ্যমান। পুরুষতান্ত্রিকতা মানে অগণতান্ত্রিকতা, এককেন্দ্রিককতা, স্বার্থপরতা। সমাজ থেকে পুরুষতান্ত্রিকতা আমরা যদি নিঃশেষ না করতে পারি, বর্জন করতে না পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত নারীরা সংকটে থেকেই যাবে। সমাজ থেকে পুরুষতান্ত্রিকতা বর্জন করতে নারী এবং পুরুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নারীরা অনেক প্রশিক্ষণ পেয়েছে এখন দরকার পুরুষদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পুরুষকেই এখন বেশি সচেতন করতে হবে, পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। এটাই হওয়া উচিত এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলানিউজ: এখনও দেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ কম। এর কারণ কী?
শিরিন আখতার: সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীদের যে বাধার শিকার হতে হয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সেই একই বাধার সম্মুখীন হতে হয়। নারীরা কিছু বোঝেন না, একজন নারী পুরুষের মতো সব জায়গায় যাওয়া-আসা করতে পারবেন না, নারীরা লোকজনদের সংগঠিত করতে পারবেন না, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এমন অপরিপক্ক এবং যুক্তিহীন কথা বলে নারীদেরকে পিছিয়ে দেওয়া হয়। নারীদের জায়গা করে দিলে, সুযোগ দিলে সে তার যোগ্যতা দিয়েই নিজের স্থান তৈরি করে নেবে। সেনাবাহিনী, শান্তিরক্ষা মিশনে, পুলিশে, বিমান বাহিনীতে সব জায়গায় মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলানিউজ: আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাংলাদেশের নারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
শিরিন আখতার: বাংলাদেশের নারীদের নিজেদের শক্তির ওপর নিজেদেরকেই প্রথমে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। নারীর শক্তি এটা অনেক বড় একটা শক্তি। নিজেদের শক্তির ওপর নারীরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করে, সেই শক্তির ওপর ভর করে নারীরা যদি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়, তাহলে কোনো বিপথগামী শক্তিই তার অগ্রযাত্রা থামাতে পারবে না। সব বাধা অতিক্রম করে নারীরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবেই। বাংলাদেশের নারীদের আমি নারীর সেই শক্তির ওপরেই বিশ্বাস করে দাঁড়াতে বলবো।
আরও পড়ুন>>
নারীকে ব্যক্তিজীবনে আরো সাবলম্বী হতে হবে: আনোয়ারা সৈয়দ হক
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩১ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২০
আরকেআর/এজে