নিজেকে ‘সত্য ব্যবসায়ী’ দাবি করলেও ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ গাড়িও আমদানি করেছেন তিনি।
এ কারণে মুসার বিরুদ্ধে দুটি মামলা চলমান রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
তার ছেলের নাম ববি হাজ্জাজ। যিনি নিজের তৈরি একটি রাজনৈতিক দলের আবার প্রধান নেতাও। মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনিও বাপের চেয়ে একবিন্দু কম নন। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে এরশাদের উপদেষ্টা কিংবা জাতীয় পার্টির মুখপাত্র হওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া কিছুদিন ধরেই তিনি সরকারের সমালোচনার নামে প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার। এছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল ধরাতেও তার অপচেষ্টার কমতি নেই।
মুসার বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি হয়েছিলো ২০১৬ সালে, দ্বিতীয়টি ২০১৯ সালে। কিন্তু এর কোনটিরই এখন পর্যন্ত চার্জশিট দিতে পারেনি সংস্থাটি।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১০ মার্চ মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে প্রথম মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়। সম্পদের মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর রমনা থানায় এ মামলা করেন দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী।
মামলায় দুদক আইনের ২(২) ধারায় সম্পদের বিষয়ে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার এবং ২৭(১) ধারায় জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ দখলে রাখার অভিযোগ আনা হয়।
আরও পড়ুন: মুসাপুত্র হাজ্জাজের ভারতবিরোধী পাঁয়তারা কার মদদে
২০১৫ সালের জুনে দুদকে দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে মুসা বলেছিলেন, সুইস ব্যাংকে তার ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ‘ফ্রিজ’ অবস্থায় রয়েছে। এর পাশাপাশি সুইস ব্যাংকের ভল্টে তার ৯০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের অলংকার জমা রয়েছে। তবে এসব অর্থের কোনো দালিলিক তথ্য দুদককে দেখাতে পারেননি ফরিদপুরের ‘নুলা রাজাকার’ হিসেবে কুখ্যাত মুসা।
সুইস ব্যাংকে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরকে। দুদকের প্রধান কার্যালয়ে বিশাল গাড়ির বহর আর সুসজ্জিত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে এসে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করেন মুসা।
দুদক তার বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ জারি করায় ২০১৫ সালের ৭ জুন সম্পদের হিসাব দেন মুসা বিন শমসের। সেদিন সুইস ব্যাংকে ২০০৮ সাল থেকে জব্দ থাকা ১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের লিখিত হিসাব দেন তিনি। বাংলাদেশি টাকায় যা ৯৩ হাজার কোটি টাকার (সে সময়কার প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে) সমপরিমাণ। তার দাবি, অর্থ ছাড়াও সুইস ব্যাংকে জব্দ রয়েছে তার মূল্যবান হীরকখচিত কলমসহ ৯০ কোটি টাকার ব্যবহার্য অলঙ্কারও।
আরও পড়ুন: রহস্যজনক অপতৎপরতায় মেতেছেন ববি হাজ্জাজ
ফরিদপুরের ‘নুলা রাজাকার’ মুসা দেশ স্বাধীনের পর পালিয়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। শাহবাজ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি আদম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আশির দশকের শুরুতে অংশীদারিত্বের ব্যবসা দিয়ে শুরু করার পর থেকেই নানা বিতর্কের জন্ম দেন মুসা। সে সময় থেকেই তার বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।
দুদক সূত্র জানায়, তিন দশক ধরে গণমাধ্যমে এসব তথ্য প্রচার হলেও এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ তাদের কাছে ছিলো না। আইনজীবীর মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ এ অর্থের হিসাব দাখিল করার পর দুদক অনুসন্ধান শুরু করে।
দুদকের কাছে ১৬ পৃষ্ঠার সম্পদ বিবরণীতে বিদেশি ব্যাংকে জব্দ থাকা বিপুল পরিমাণ এ অর্থের ‘দালিলিক তথ্য’ দিলেও দেশে থাকা সম্পদের পরিমাণ নগণ্য বলে উল্লেখ করেন মুসা।
দুদক সূত্র জানায়, সম্পদ বিবরণীতে সুইস ব্যাংকের ওই অর্থ ছাড়াও গাজীপুর ও সাভারে তার নামে বিভিন্ন দাগে প্রায় ১২শ’ বিঘা সম্পত্তি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন মুসা। তার দাবি, ১৯৭২-৭৩ সালে ওইসব সম্পত্তি ক্রয় করলেও এগুলো বর্তমানে তার দখলে নেই। এসব সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার ওপরে (এক বিঘা এক কোটি টাকা হিসেবে)।
সূত্রটি আরও জানায়, বনানীতে মেসার্স ড্যাটকো লিমিটেড নামে একটি জনশক্তি রফতানি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মুসা বিন শমসের। তবে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানটির আরো কয়েকজন অংশীদার রয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানের নামে ঢাকায় দুইটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তবে মুসার নিজের নামে দেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কথা সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়নি।
এছাড়া দেশে গুলশানে দ্য প্যালেস নামে ‘প্রাসাদতুল্য’ বাড়িটি তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা চৌধুরীর নামে। এটি এখন একটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য। এসব সম্পদের বাইরে মুসার ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায় রয়েছে তিনতলা পৈত্রিক বাড়ি, যেটিতে অংশীদারিত্ব রয়েছে মুসাসহ পাঁচ ভাই-বোনের।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুসা বিন শমসের সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, সুইস ব্যাংকে জব্দকৃত তার অর্থ অবমুক্ত হলে এসব অর্থ পদ্মাসেতু নির্মাণসহ পুরো টাকাই দেশে বিনিয়োগ ও মানবকল্যাণে ব্যয় করবেন তিনি।
অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিলেও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য মুসা দুদককে দেননি। এ বিষয়ে সে সময় দুদকের পরিচালক মো. সাহাবুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ব্যবসার গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই অস্ত্র ব্যবসার কোনো তথ্য তিনি দেননি। সুইস ব্যাংকে আটকে থাকা টাকা তিনি বিদেশে অস্ত্র ব্যবসা করে অর্জন করেছেন বলে দাবি করেন। তার অস্ত্রের ব্যবসা ছিল, এখনো রয়েছে।
মুসা দুদকে হাজার হাজার কোটি টাকা সম্পদের হিসাব দিলেও সংস্থাটি এর কোনটারই সত্যতার প্রমাণ পায়নি। মুসার পাঁচটি গাড়ি ও গুলশানে স্ত্রীর নামে একটি বাড়ি আর ফরিদপুরে সামান্য জমি ছাড়া আর কোনো সম্পদেরই হিসাব খুঁজে পায়নি দুদক। মুসার সবচেয়ে আলোচিত সম্পদ সুইস ব্যাংকের বিলিয়ন ডলারের কোনো দালিলিত প্রমাণও দেখাতে পারেনি দুদককে। সে সঙ্গে মিথ্যা তথ্য প্রদান ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের এসব মামলার তদন্তে মুসার কাছ কোনো প্রকার সহযোগিতাও পাননি দুদকের কর্মকর্তারা।
এরপরই অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় মুসার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনের কাজ শেষ করে ২০১৬ সালের ১০ মার্চ মুসার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর ভুয়া কাগজ দেখিয়ে নিষিদ্ধ রেঞ্জ রোভার জিপ গাড়ি আমদানি ও ভুয়া কাগজপত্রে নিবন্ধনের অভিযোগে মুসার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করে দুদক। এ মামলটিও করেন দুদক পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী। তিনি কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ মামলাটি দায়ের করেন। গাড়িটি আমদানির ক্ষেত্রে কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধা নেওয়া হয়েছিল।
এ মামলায় মুসা ছাড়াও আরও চারজন আসামি রয়েছেন। তারা হলেন- বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভোলা জেলা সার্কেলের সহকারী পরিচালক মো. আইয়ুব আনছারী, গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অটো ডিফাইন ও ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. ওয়াহিদুর রহমান, মুসা বিন শমসেরের শ্যালক মো. ফারুক-উজ-জামান এবং 'কার্নেট ডি প্যাসেজ' সুবিধায় গাড়ি আনা ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ব্যক্তি ফরিদ নাবির।
মামলার এজাহারে বলা হয়, মুসাসহ অন্যান্য আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিআরটিএ ভোলা অফিসে দাখিল করে কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় আনা বিক্রয় নিষিদ্ধ রেঞ্জ রোভার গাড়ির নিবন্ধন করে। গাড়িটির নিবন্ধন নম্বর- ভোলা-ঘ-১১-০০৩৫।
দুদক সূত্র জানায়, কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ফরিদ নাবির গাড়িটি বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বিআরটিএর নিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী, গাড়িটির মালিক মুসার শ্যালক মো. ফারুক-উজ-জামান চৌধুরী। ২০১০ সালের ১২ মার্চ গাড়িটি দেশে আনা হয়। শুল্ক গোয়েন্দারা ২০১৭ সালের ২১ মার্চ গাড়িটি আটক করেন।
২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল মুসাকে শুল্ক গোয়েন্দা অফিসে তলব করা হয়। কিন্তু তিনি উপস্থিত না হয়ে বাকশক্তি হারানোর নাটক সাজান এবং তিন মাস সময় চান।
এরপর ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই শুল্ক আইন-১৯৬৯ অনুযায়ী, দুই কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩৩ টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলার বাদী ছিলেন অধিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন।
ওই মামলার পরে মুসা বিন শমসের যেন দেশ ছেড়ে যেতে না পারেন, সে জন্য পুলিশের বিশেষ শাখার কাছে চিঠি পাঠায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শহীদুজ্জামান সরকার স্বাক্ষরিত এ চিঠি বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজিপি বরাবর পাঠানো হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর শুল্ক কর ফাঁকির অভিযোগে মামলাটি করলেও, ভুয়া কাগজপত্রে বিআরটিএ কর্মকর্তা নিবন্ধন করার অপরাধের বিষয়ে কোনো প্রকার আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে এনবিআর থেকে দুদকে অভিযোগটি পাঠানো হয়। দুদক মামলার অনুসন্ধান করলে, দেশে বিক্রি নিষিদ্ধ ওই গাড়ি আমিদানি ও ভুয়া কাগজপত্রে নিবন্ধনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। যার ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর মামলাটি করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ফরিদ নাবির কর্তৃক কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় বিনা শুল্কে আনা গাড়িটি মুসার দখলে ছিলো। সেখান থেকেই শুল্ক গোয়েন্দারা গাড়িটি আটক করেন। ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে মুসা তার শ্যালক ফারুক-উজ-জামান চৌধুরীর নামে গাড়িটি নিবন্ধন করান।
সূত্রটি আরো জানায়, ২০১০ সালের ১২ মার্চ থেকে ২০১৭ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত সময়ে এ জালিয়াতির ঘটনাটি ঘটে। যা ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ৪২০/১০৯ ধারা লঙ্ঘন করায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এসব মামলার অগ্রগতি বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বাংলানিউজকে বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। অনুসন্ধান শেষ হলে চার্জশিট দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০২০
ডিএন/এজে