সিরাজগঞ্জ: কখনো সবুজে ভরা মাঠ, কখনো সোনারঙা ধানে ভরা প্রান্তর। আবার কখনো মাঠ-ঘাট, খালবিলে খেলে যায় বিশাল জলরাশির ঢেউ।
ঈদের ছুটিতে বিনোদনের জন্য তাই চলনবিলকে বেছে নিতে পারেন অনেকেই। বিশেষ করে বর্তমানে বর্ষা মৌসুম হওয়ায় পানিতে থই থই করা চলনবিলের বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে শান্ত সমুদ্রের প্রতিচ্ছবিই মনে হয়। ধবধবে সাদা বিশাল জলরাশির মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো কাশবন, কোথাও বা দু একটি ছায়াশীতল বৃক্ষ। এরই মাঝখানে ছোট-বড় নদী খাল বেয়ে চলে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌকা। আবার সাদা ধবধবে পাল তোলা মাছ ধরা নৌকারও দেখা মেলে কদাচিৎ। বিস্তীর্ণ এ বিলটির মাঝে মাঝে ছোটবড় গ্রামগুলোকে ক্ষুদ্র দ্বীপের মতই মনে হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা ও ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া ও বড়াইগ্রাম এবং নওগাঁর আত্রাই এ ১০টি উপজেলার সীমান্তবর্তী নিম্নাঞ্চলই হচ্ছে চলনবিল। প্রায় দুই হাজার গ্রামের এই বিলটিতে ৩৯টি বিভিন্ন আকৃতির ছোট-বড় বিল, ১৬টি নদী ও ২২টি খাল রয়েছে। নদীগুলির মধ্যে করতোয়া, আত্রাই, বড়াল, গুড়, হিজলী, তুলশী, ইছামত, নন্দকুজা, গুমানী, চৈচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, কুমারডাঙ্গা, মরা আত্রাই ও করতোয়া উল্লেখযোগ্য।
প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য ধারণ করা এ বিলটিকে ঘিরে বেঁচে আছে উত্তরাঞ্চলের ৪টি জেলার ১০টি উপজেলার প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। ১৯৯০ সালের জরিপমতে ফসলি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর হলেও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে অনেক কমে এসেছে।
প্রায় দুশো বছর আগে বৃটিশ সরকারের আমলে এ বিলের বুক চিরে তৈরি হওয়া ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলসড়কটি এর সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে চারদিক থৈ থৈ পানির মাঝখান দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা রেলসড়কের সৌন্দর্য্য প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে টানে।
১৯৯৮ সালে নির্মাণ করা হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কটি এ বিলের মাঝখান দিয়েই চলে গেছে। মহাসড়কটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া অসংখ্য ছোট বড় সড়ক এঁকেবেঁকে চলে গেছে গাঁয়ের মাঝখানে। বর্ষাকালে এসব সড়কের অধিকাংশই ডুবে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন মৌসুমেই ঐতিহ্যবাহী চলনবিলে প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের ঢল নামে। শীতকালে মাঠের পর মাঠ সরিষা ফুলের হলুদ সমুদ্র, বসন্তে সেটাই সবুজে শ্যামলে ঢেকে যায়। গ্রীষ্মে সোনারাঙা ধানের মাঠে ছেয়ে যায়, আবার বর্ষায় জলে থই থই করে চারিধার। এটাই চলনবিলের বৈশিষ্ট্য।
হামকুড়িয়া, কুন্দইল, বারুহাস, বিনসাড়া, নওগাঁ এলাকার স্থানীয়রা জানান, বর্ষা মৌসুমে চলনবিল অঞ্চলে বিভিন্ন জেলার শত শত মানুষ নৌভ্রমণে আসে। দিনভর নৌবিহারীদের মাইকের শব্দে মুখরিত হয়ে থাকে পুরো এলাকা। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া ছাড়াও দূর-দূরান্তের জেলা থেকেও এ অঞ্চলে ভ্রমণ করতে আসে মানুষ।
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের অনার্স শেষবর্ষের ছাত্র ও তাড়াশের হামকুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা কিবরিয়া সিদ্দিকী জানান, বিলে যখন পানি আসা শুরু করে তখন থেকেই দর্শনার্থীদের ভিড় শুরু হয়।
পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মনিরুল ইসলাম বলেন, বর্ষাকালে চলবিল তার প্রকৃত রূপ ফিরে পায়। এ রূপ দেখতে সব শ্রেণীপেশার মানুষেরই ভিড় জমে। এটা আমাদের জন্যও সুখবর।
নওগাঁ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম মৃধা বলেন, বর্ষা মৌসুমে এই এলাকাতেই প্রতিদিন গড়ে ৬/৭শ পর্যটক আসে। এছাড়াও বিলশা, কুন্দইল, বিলচলন, বারুহাস, নওগাঁসহ বিভিন্ন এলাকাতেই হাজার হাজার মানুষের ভিড় হয়।
মাগুরা বিনোদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, আতিকুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আমার এলাকাতেই বনভোজনের জন্য প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক নৌকা নিয়ে মানুষ আসে। করোনার কারণে বর্তমানে সেটা কম হলেও ১০/১৫টি নৌকা তো আসেই।
সগুনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহেল বাকী বলেন, তার ইউনিয়নের কুন্দইল ও পার্শ্ববর্তী বিলশা অঞ্চলেই পর্যটকদের ভিড় বেশি দেখা যায়। ঈদে এই সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে যাবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৮ ঘণ্টা, ০১ আগস্ট, ২০২০
আরএ