জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র জুবায়ের আহমেদের হত্যার কারণ সম্পর্কে পুলিশ এখনও স্পষ্ট হতে পারেনি।
তবে পুলিশের ধারণা, ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে হল থেকে বিতাড়িত এবং র্যাগিংয়ের শিকার কিছু শিক্ষার্থীর প্রতিশোধের বলি হয়েছেন জুবায়ের।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে যে, ক্যাম্পাসজুড়ে জুবায়ের হত্যাকাণ্ডটিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখা হলেও ঘটনার তিনদিন পর পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত বলছে ভিন্নকথা।
পুলিশের ভাষ্যমতে, প্রথমবর্ষের ছাত্রদের র্যাগিং দেওয়াকে কেন্দ্র করেই সুযোগ সন্ধানী ও প্রতিশোধপরায়ণ একদল শিক্ষার্থী এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে তাদের ধারণা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে প্রশাসনিক ভবনের কাউন্সিল কক্ষে অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম এসব বিষয় আলোচনা করেন।
এ সময় বাংলানিউজের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ওয়ালিউল্লাহ ওলিও ছিলেন।
তবে এ হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ হলের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী, যারা প্রত্যক্ষভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের কর্তৃত্ব ছিল জাবি শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন ও তার সমর্থকদের হাতে। সে সময় নিহত জুবায়ের সভাপতি গ্রুপের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
অভিযোগ আছে, ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই ক্যাম্পাসজুড়ে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের গ্রুপিং শুরু হয়। এ সময় ২ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রক্টরের নেতৃত্বে এবং ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলামের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু হল থেকে শাফিন গ্রুপকে বিতাড়িত করে উপাচার্যপন্থি শামীম-শরিফ গ্রুপকে হলে উঠিয়ে দেওয়া হয়।
ফলে শাফিন গ্রুপ ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয় এবং বিতাড়িত গ্রুপের সদস্য হিসাবে জুবায়েরও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জুবায়েরকে হত্যা করা হয়েছে- এমন বক্তব্যের পেছনের কথা মূলত এটিই। তবে রাজনীতি করার সময় জুবায়েরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে পুলিশ অনুসন্ধান চালানো শুরু করেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা অবস্থায় জুবায়ের নিজের ব্যাচের বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের মানসিক এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন।
জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বহিষ্কৃত খন্দকার আশিকুল ইসলাম নির্যাতিতদের একজন বলে এরই মধ্যে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
তবে জুবায়েরের সহপাঠীদের সূত্র মতে, হল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর জুবায়ের ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতেন এবং লেখাপড়ায় পূর্ণ মনোনিবেশ করে। রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকলেও জুবায়ের তার বন্ধুদের কাছে মাঝে মধ্যেই হামলার শিকার বা মার খাওয়ার আশঙ্কার কথা প্রকাশ করতেন।
জুবায়েরের আশঙ্কা সত্যি হয় যখন আশিকুল ইসলাম, রাশেদুল ইসলাম এবং খান মোহাম্মদ রইস গত রোববার বিকেলে তার ওপর নৃশংস হামলা চালায়।
এ সময় রফিক-জব্বার হলের অরূপের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বর্ষের প্রায় ১০-১৫জন শিক্ষার্থী তাদের সহযোগিতা করে বলেও জানা গেছে।
ক্যাম্পাসজুড়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, সোমবার ভোরে জুবায়ের মারা যাওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাম্পাসের বিশেষ বিশেষ কয়েকটি স্থানে ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। এমনকি উপাচার্যের সমর্থক এক ছাত্রলীগ নেতাকে ভোরবেলায় ভিসির সঙ্গে দেখা করে আসতে দেখা যায়।
জুবায়েরের মৃত্যুর খবর ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে সকালেই আশিককে আটক করে পুলিশ। তবে ঘটনার নেতৃত্বদানকারী অরূপকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানায় পুলিশ।
এদিকে ঘটনার পর গতকাল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক শেখ রাসেল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম জুবায়েরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনও কার্যক্রম ও কমিটি নেই। যারা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে পরিচয় দিচ্ছেন তারা সুবিধাভোগী এবং দুষ্কৃতকারী।
তবে মঙ্গলবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে যখন শিক্ষক এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা চারদফা দাবিতে প্রশাসনিক ভবনের সামনে আন্দোলন করছিলেন, ঠিক তখন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হলগেট বন্ধ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোর করে মিছিল করতে বাধ্য করে ছাত্রলীগ। যদিও মিছিলটি শেষে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয়।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঘটনা সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আগামীকাল (বুধবার) সকালে শিক্ষক সমিতির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
সভাশেষে মূলত একটি সিদ্ধান্তে আসা যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জন্য শুভ হবে।
তিনি আরও বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোর ধারা-প্রকৃতি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, পরিস্থিতি যতটা নাজুক হওয়ার কথা ছিল, অন্তত এবার সে রকম কিছু হবে না। ”
অভিযুক্ত অন্যান্যদের আটকের ব্যাপারে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের আটকের ব্যাপারে পুলিশি তদন্ত অব্যাহত আছে।
এছাড়াও হত্যাকাণ্ডের সঠিক কারণ সম্পর্কে গ্রেপ্তারকৃত আশিকের কাছ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
তবে তদন্তের স্বার্থে এ ব্যাপারে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১২