ঢাকা: স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাউন্ডুলে হয়ে ওঠে হৃদয়। তখন বয়স মাত্র ১২ বছর।
শুধুু উত্তরখান ও দক্ষিণখান নয়, কিশোর গ্যাং ‘দি বস’ গ্রুপ উত্তরা ৬ ও ৮ নম্বর সেক্টরে নানা অপকর্ম ও তাণ্ডব চালাতো। নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে এলাকায় অন্যান্য গ্রুপের সঙ্গে আবার অন্য এলাকার গ্রুপের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া ফেসাদে ও মারামারির ঘটনাও ঘটাতো। বয়সে সবাই কিশোর হলেও তারা কাউকে মারধর করতে দ্বিধাবোধ করতো না।
নিজেদের প্রভাব, ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে গত ২৭ আগস্ট রাত সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর উত্তরখান থানাধীন রাজাবাড়ি খ্রিষ্টানপাড়া এলাকায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক রিকশা চালককে মারধরের প্রতিবাদ করায় কলেজ শিক্ষার্থী মো. সোহাগকে (২০) মারধর করে। মারধরের একপর্যায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে কিশোর গ্যাং ‘দি বস’ গ্রুপের সদস্যরা।
ঘটনার পরদিন (২৮ আগস্ট) নিহতের বড় ভাই মেহেদী হাসান সাগর বাদি হয়ে উত্তরখান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহারে মাহবুবুল ইসলাম রাসেল ওরফে কাটার রাসেল (২০), মো. হৃদয় (২২), সাদ আল রাফীকে (২০), সাব্বির হোসেন (২০) ও সানি (২১) এর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৪/৫ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার দিনই উত্তরখান এলাকা থেকে মামলার ৪ নম্বর আসামি সাব্বির হোসেন (২০) কে গ্রেফতার করে থানা পুলিশ। এরপর মামলার তদন্তভার পায় গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উত্তরা বিভাগ। এরপর ৫ সেপ্টম্বর বিকালে রাজধানীর খিলগাঁও গোড়ান এলাকা থেকে আসামি সাদ আল রাফীকে (২০) এবং গাজীপুরের গাছা এলাকা থেকে নাজমুল হুদা ওরফে নাদিমকে (২০) গ্রেফতার করে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উত্তরা বিভাগ। তবে হত্যাকান্ডের মুল দুই আসামি পলাতক থেকেই যায়। গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-১ ছায়া তদন্ত শুরু করে।
ঘটনার ২৬ দিন পর অভিযান চালিয়ে দক্ষিণখান এলাকায় থেকে সোহাগ হত্যাকাণ্ডের মুল দুই আসামি মাহবুবুল ইসলাম রাসেল ওরফে কাটার রাসেল (২০) ও মো. হৃদয় (২২) গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১)। এসময় তাদের হেফাজত থেকে দুইটি বিদেশী পিস্তল, দুইটি ম্যাগাজিন ও আট রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র্যাব-১।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানায়, ঘটনার দিন উত্তরখানের রাজাবাড়ি খ্রিষ্টানপাড়া রোডের ডাক্তার বাড়ি মোড়ে হৃদয়, রাসেলসহ বেশ কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিল। এমন সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটি রিক্সার চাকা হতে কাঁদা ছিটকে হৃদয়ের গায়ে লাগলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে রিক্সা চালককে মারধর করতে থাকে। এতে সোহাগ বাধা দিলে হৃদয় ও রাসেল ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারধর করে। এবং ফোন করে নাদিম, সানি, মেহেদী, সাদ, সাব্বিরসহ বেশ কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে আসে। এক পর্যায়ে সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে কাটার রাসেল সোহাগের পেটে আঘাত করে। পরে তারা সবাই পালিয়ে যায়।
এ বিষয়ে র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফট্যানেন্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হৃদয় ও কাটার রাসেল হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। হত্যাকাণ্ডের পর হৃদয় গ্রুপের সবাইকে পালিয়ে থাকার জন্য বলে। এরপর সেও পালিয়ে যায়। এতে রাসেলও আত্মগোপনে চলে যায়। গ্রেফতার এড়াতে তারা ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করতো। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় হৃদয় ও কাটার রাসেল দুইজনই দেশ ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করে। তার প্রস্তুতি নিতেই তার পুনরায় ঢাকায় আসছে। এতে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তাদের গ্রেফতার করি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাংলানিউজকে জানান, হৃদয় কিশোর গ্যাং ‘দি বস’ গ্রুপের লিডার। তার এই গ্রুপের কাটার রাসেল, নাদিম, সানি, মেহেদী, সাদ, সাব্বিরসহ এলাকার উঠতি বয়সের বেশ কয়েকজন কিশোর রয়েছে। উত্তরায় একটি ওয়ার্কশপে কাজের পাশাপাশি সে এলাকা এই গ্রুপ পরিচালনা করতো। এদিকে অপর আসামি মাহবুবুল ইসলাম ওরফে কাটার রাসেল ২০১৮ সালে ফায়দাবাদ আলিয়া মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়াশুনা করে। এরপর সে উত্তরা আইডিয়াল কলেজে এইচএসসি ২য় বর্ষে শিক্ষার্থী। কিশোর গ্যাং ‘দি বস’ গ্রুপে সে হৃদয়ের নির্দেশনা মত চলতো। রাসেলের সঙ্গে সবসময় একটি ছুড়ি বা ক্ষুর রাখতো। কথায় কথায় সে পায়ের রগ কেটে ফেলার হুমকি দিতো বলে গ্রুপের সবাই তাকে কাটার রাসেল বলে ডাকতো।
এদিকে, গ্রেফতার আসামি হৃদয় ও কাটার রাসেল দুইজনের বিরুদ্ধে দক্ষিণখান থানায় অস্ত্র আইনে একটি মামলাও দায়ের করেছে র্যাব-১। এবিষয়ে দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিকদার মো. শামীম বাংলানিউজকে বলেন, অস্ত্রসহ দুই আসামিকে দক্ষিণখান থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে র্যাব বাদি হয়ে একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. কায়সার রিজভী কোরায়েশী বাংলানিউজকে বলেন, এই মামলাটি ডিবি উত্তর তদন্ত করছে। আমরা আগে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সাদ আল রাফি ও নাদিম নামে দুই আসামিকে গ্রেফতার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তীমুলক জবানবন্দী দিয়েছে।
তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত মুল আসামি হৃদয় ও কাটার রাসেলকে গ্রেফতার করেছে। এই দুই আসামিকে এরেস্ট দেখিয়ে আদালতে রিমান্ডের আবেদন করবো।
পরিবার সূত্র জানায়, নিহত সোহাগের পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট। সে উত্তরা পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ এবছরের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। পাশাপাশি টঙ্গী বাজারে তার ভগ্নিপতির দোকান শুটকির ব্যবসা করতেন।
নিহত সোহাগের মা পারভীন বাংলানিউজকে বলেন, অন্যাযের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার ছেলে খুন হলো। আমার বুক খালি হয়ে গেলো। যারা আমার বুক খালি করছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই।
বাংলাদেশ সময়: ০২০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০
এসজেএ/ ডিএন/কেএআর