ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বুড়িমারী মহাসড়কটি যেন শ্মশান ঘাট!

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২০
বুড়িমারী মহাসড়কটি যেন শ্মশান ঘাট!

লালমনিরহাট: লালমনিরহাট বুড়িমারী মহাসড়কে এখনো পড়ে রয়েছে গুজব ছড়িয়ে হত্যা করা শহিদুন্নবী জুয়েলের মরদেহ পোড়ানো ছাই। বাতাসে মিশে আছে লাশের গন্ধ।

মহাসড়কটি যেন শ্মশান ঘাট!

নিহত যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়া এলাকার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাটগ্রাম উপজেলা সদর হয়ে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে না পৌঁছাতেই চোখে পড়ে মহাসড়কে পড়ে থাকা কালো ছাইয়ের দিকে। জায়গাটিকে চার দিকে ব্রেঞ্জসহ প্লাষ্টিক বাক্স দিয়ে ঘিরে রেখেছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এখনো বাজারের অনেক দোকান বন্ধ রয়েছে।

>>>লালমনিরহাটে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩ মামলা, গ্রেফতার ৫

বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ ঘেষা চা বিক্রেতা বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার আছরের নামাজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কয়েকজন টি-শার্ট পরিহিত দুই যুবককে কলার টেনে পরিষদে নিয়ে যান। মুহুর্তে ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে জমায়েত হয় দুই-আড়াইশ’ মানুষ। কোরআন অবমাননা করার গুজব ছড়িয়ে সকলেই আটক যুবকদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। পরিবেশ ক্রমে উত্তপ্ত হলে অনেকের মতো তিনিও দোকান বন্ধ করে চলে যান।  

বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের পাহারার দায়িত্ব থাকা গ্রাম পুলিশ আইয়ুব আলী বাংলানিউজকে বলেন, লোকজনের ভিড়ের কারণে যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল ও তার বন্ধু সুলতান যোবায়েরকে পরিষদের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। পরিষদের প্রবেশ গেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে ওসি, ইউএনওকে জানানো হলে প্রথমে বুড়িমারী ইমিগ্রেশন ফাঁড়ি থেকে পুলিশ এসে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি পরিষদে পৌঁছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে আলোচনায় বসেন। এরই মধ্যে সন্ধ্যার পরে পরিষদ মাঠে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। মাইক দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ কয়েকটা ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এতে জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে আর গুলি চলেনি।

দুর্বৃত্তরা এ সময় পরিষদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পরিষদের দিকে বৃষ্টির মতো পাথর ও বালু ছুড়তে থাকে। এসব প্রতিরোধ করেও টিকে ছিলেন প্রশাসনের লোকজন। এরপর পরিষদের পিছনের গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে রুমের দরজা ভেঙে জুয়েলকে ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। তখন কৌশলে জুয়েলের বন্ধু সুলতান যোবায়েরকে নিয়ে ভবনের ছাদ বেয়ে পরিষদ ত্যাগ করেন ওসি। এতেই সুলতান বেঁচে যান।

>>>গুজব ছড়িয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, মৃতদেহে আগুন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দোকানদার বাংলানিউজকে বলেন, বাজারের একজন ডেকোরেটর ব্যবসায়ী মসজিদ থেকে দুই যুবককে পেটাতে পেটাতে নিয়ে আসেন। কোরআন অবমাননা করা হয়েছে বলে ওই ডেকোরেটর ব্যবসায়ী বাজারে গুজব ছড়িয়ে দেন। এটা শুনে বাজারকারী লোকজন ছুটে যান  পরিষদে। সন্ধ্যার পরে ১২-১৮ বছর বয়সী অপরিচিত ৩০-৪০ জন কিশোর-যুবক জনতার সঙ্গে যুক্ত হয়। ভবনে ভেঙে রুমেই গণপিটুনি দিয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর একজন পুরতন কাপড় বিক্রতা (বেনামাজি মুসলিম) মরদেহের পায়ে রশি বেঁধে দিলে যুবকরা টেনে হিঁচড়ে সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে পেট্রোল ঢেলে হোটেলের জ্বালানি কাঠ দিয়ে মরদেহটি পুড়িয়ে ছাই করা হয়। এসময় ওই অপরিচিত ৩০-৪০ যুবক-কিশোর নারায়ে তাগবির শ্লোগানে দফায় দফায় মিছিল করে।  

প্রশাসন প্রথম দিকেই আটক দুই যুবককে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গেলে এমন ঘটনা ঘটতো না। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই জনবিস্ফোরণ ঘটে পরিষদ চত্বরে। তখন পরিস্থিতি প্রশাসনের নাগালের বাহিরে চলে যায়। তবে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে যারা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে হত্যা করে মরদেহ পুড়িয়ে ছাই করেছে। তাদের শাস্তির দাবি করেন ওই দোকানদার।

 

শনিবার বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে সমজিদে আছরের নামাজে আসা একজন মসুল্লি বলেন, কোরআন অবমাননা হয়নি। এটা স্রেফ একটি গুজব। বিগত দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নারায়ে তাগবির শ্লোগানে বহিরাগত কিছু যুবক পুরো পাটগ্রাম উপজেলাকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। অসংখ্য বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিল। এতেও ৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ গুজবের ঘটনায় তাদের হাত থাকতে পারে।  

এদিকে এ ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের করে ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পাটগ্রাম থানা পুলিশ। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর। তবে ঘটনাটির ছায়া তদন্ত করছে র‍্যাব। বুড়িমারী এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টহল অব্যহত রয়েছে।

বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাংলানিউজকে বলেন, এটা একটি গুজব। হামরাকারীরা বহিরাগত হওয়ায় মাইকে বলেও শান্ত করা যায়নি। তার পরিষদে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় তিনিও একটি মামলা দায়ের করেছেন।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।