ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার সত্যতা পায়নি মানবাধিকার কমিশন 

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২০
বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার সত্যতা পায়নি মানবাধিকার কমিশন 

লালমনিরহাট: লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে গণপিটুনিতে নিহত শহীদুন্নবী জুয়েল কোরআন অবমাননা করেননি। গুজব ছড়িয়ে তাকে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করেছেন জাতীয় মানবধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত দলের পরিচালক আল মাহমুদ ফাউজুল কবির।

রোববার(১ নভেম্বর) দুপুরে তদন্ত শেষে বুড়িমারী ডাকবাংলোতে সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা বলেন তিনি।  

বুড়িমারী বাজার জামে মসজিদ, বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ, নিহত জুয়েলের মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার স্থান পরিদর্শন ও  বিভিন্নজনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর এসব কথা বলেন তিনি।

জাতীয় মানবধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত টিমের পরিচালক আল মাহমুদ ফাউজুল কবির বলেন, পুরো ঘটনাকে তিন ভাগে ভাগ করে তদন্ত করা হচ্ছে। সাক্ষীরা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন, ফলে ঘটনাটি পরিকল্পিত কি না, তা মাথায় রেখে তদন্ত করছি।  

তিনি আরও বলেন, মসজিদের ইমাম ও খাদেমের সঙ্গে কথা বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, জুয়েল কোরআন অবমাননা করেননি। তার বিরুদ্ধে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়ানো হয়েছে। জুয়েল কেন বুড়িমারীতে এসেছিলেন? তাকে যখন মারধর করা হয়, তখন তার সঙ্গে থাকা অপর লোকটি তাকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন কি না? আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি হঠাৎ করে কেন তাকে মারধর করলেন?  ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হাফিজুল কেন জুয়েলকে অন্য স্থানে না সরিয়ে দীর্ঘক্ষণ পরিষদে আটকে রাখলেন? কি কারণে অনেক পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হলো? বহিরাগত লোকজন কার ডাকে এসেছিল? এ ঘটনায় কারো ইন্ধন ছিল কি না?  এসব বিষয়ে তদন্ত করতে হচ্ছে। তদন্ত শেষ করে সাতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

এর আগে মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দল নিহত জুয়েলের সঙ্গী পুলিশের হেফাজতে থাকা আহত সুলতান যোবায়েরের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পি এম রাহসিন কবির, সিনিয়র  সহকারী পুলিশ সুপার তাপস সরকার উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হারিয়ে ফেলেন তিনি।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, শহিদুন্নবী জুয়েল বৃহস্পতিবার বিকেলে সুলতান যোবাইয়ের আব্দার নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা।

নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ে পড়ে যায়। এ সময় কোরআর ও হাদিস বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান যোবাইয়েরকে পাশে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখে। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।  

সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। এ সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে  জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় স্থানীয়রা। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।

সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ও পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান যোবাইয়েরকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ।  

ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুক্রবার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টি এম এ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানায় পুলিশ।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০২০
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।