লালমনিরহাট: বর্ষাকালে বন্যা আর তিস্তার হিংস্র স্রোতে বিলীন হয় ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা সেই বালুচর দখলে নিতে গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলে প্রভাবশালী দখলদারদের।
জানা গেছে, ভারতের সিকিম উপত্যকা থেকে সৃষ্ট তিস্তা নদী ভারতের ভূমি বেয়ে নীলফামারীর খড়িবাড়ি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তা নদী লালমনিরহাট জেলার দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে ৫টি উপজেলাকে প্রবাহিত করে ব্রক্ষ্মপুত্রে মিশে গেছে। উজানে ভারত সরকার গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে এক তরফা নদীশাসন করছে। ফলে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে ধেয়ে এসে বন্যা আর তীব্র ভাঙনের কবলে পড়ে এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে বাংলাদেশ অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়।
বর্ষাকালে বন্যার প্রবল স্রোতে লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার অসংখ্য ঘরবাড়ি ও মাইলের পর মাইল ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। এসব জমি শুষ্ক মৌসুমে ফের জেগে ওঠে।
শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা এসব জমি দখলে নিতে তৎপর হয়ে ওঠে দখলদাররা। চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি মামলা। মামলা নিষ্পত্তি না হতেই ফের বন্যা এবং ভাঙন শুরু হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত জমি হারানোর ভয় তাড়া করে চরাঞ্চলের মানুষদের। নদীগর্ভে বিলীন হওয়া জমি রেজিস্ট্রি মূলে মালিকানা বিক্রি হয় না। তবে অনেকেই অভাবে পড়ে জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করেন। তবে তা নামেমাত্র দামে। বিধিসম্মত না হলেও চরাঞ্চলের জমি বিক্রির এ নিয়ম মান্ধাতা আমল থেকে চলে আসছে। এক্ষেত্রে ক্রয়-বিক্রয়েও প্রতারণার শিকার হন বলেও চরবাসীর অভিযোগ। এ চিত্র জেলার অর্ধশত চরাঞ্চলে।
সম্প্রতি কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের শালহাটি নোহালি মৌজার মৃত সিদ্দিক আলীর ছেলে আমিন উদ্দিনের একক নামে ২১ নম্বর খতিয়ানের ৩৯.৭০ একর জমি বি.আর এসে রেকর্ডভুক্ত হয়। যা তাদের স্ট্যাম্পমূলে ক্রয়কৃত জমি বলে দাবি।
অপরদিকে স্ট্যাম্পমূলে বিক্রেতারা বর্তমানে ওই জমি রেকর্ডভুক্ত হওয়ায় তা মানতে নারাজ। তাদের দাবি তিস্তার চরাঞ্চলের এসব জমি সরকারি খাস খতিয়ানে রেকর্ড করার কথা। কিন্তু তৎকালীন সেটেলমেন্ট কর্মকর্তাদের অবৈধ সুযোগ দিয়ে সরকারি খতিয়ানভুক্ত জমি নিজের নামে রেকর্ড করেন নেন আমিন উদ্দিন। ওই রেকর্ড সংশোধন ও তৎকালীন সেটেলমেন্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করে ভূমি সচিব বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ওই গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে মিজানুর রহমান।
সম্প্রতি প্রায় ৪০ একর জমি দখল নিয়ে আমিন উদ্দিন গংদের সঙ্গে গ্রামবাসীর কয়েক দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে। এ নিয়ে উভয়পক্ষই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
ওই গ্রামের আব্দুস সালাম ও মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবছর বর্ষাকালে নদী ভাঙনে সবকিছু বিলীন হয়ে যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠে। সরকারি খাসখতিয়ানভুক্ত জেগে ওঠা এসব চরে স্থানীয় ভূমিহীনরাই চাষাবাদ করে সংসার পরিচালনা করেন। কিন্তু টাকার বিনিময়ে এসব খাস জমি নিজ নামে রেকর্ড করে দখল করেন আমিন উদ্দিন গংরা। সরকারি খাস জমি উদ্ধার করে ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করতে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।
তবে এসব অভিযোগ নিয়ে রেকর্ডমূলে জমির মালিক আমিন উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি তার রেকর্ডকৃত জমির স্ট্যাম্পমূলে ক্রয়ের কাগজপত্র দেখিয়ে বলেন, চরাঞ্চলের জমি আগে খাস খতিয়ানভুক্ত থাকায় রেজিস্ট্রিমূলে বিক্রি করা সম্ভব ছিল না। এ কারণে স্ট্যাম্পমূলে চরাঞ্চলের জমি ক্রয় করেছি। ১৯৮০-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এসব বালুচর কম দামে ক্রয় করেছি। এখন জমি জেগে ওঠায় দাতার উত্তরাধিকাররা অস্বীকারের চেষ্টা করছে। আমার বৈধ কাগজপত্র দেখে সেটেলমেন্টের সার্ভেয়াররা রেকর্ড করেছেন। সরকার দেখে বুঝে আমার নামে রেকর্ড করেছে। দালালরা কিছু পাওয়ার আশায় গ্রামবাসীকে লেলিয়ে দিয়েছে। তিনিও ন্যায় বিচার দাবি করেন।
লালমনিরহাট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুহাম্মদ রাশেদুল হক প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, খাস খতিয়ানভুক্ত জমি সরকারি সম্পত্তি। যা ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো নিয়ম নেই। যদি কেউ স্ট্যাম্পমূলে ক্রয় করে নিজ নামে রেকর্ডভুক্ত করে থাকেন, সেটাও বিধিসম্মত নয়। রেকর্ড কর্তন করতে সরকার মামলা করতে পারে। এমন কিছু হয়ে থাকলে তা খোঁজ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০২০
আরএ