ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শুষ্ক মৌসুমেও নয়নাভিরাম হাকালুকি

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২০
শুষ্ক মৌসুমেও নয়নাভিরাম হাকালুকি শুষ্ক মৌসুমেও নয়নাভিরাম হাকালুকি। ছবি: মাহমুদ হোসেন

সিলেট: ঋতুর বৈচিত্রে মুগ্ধতা ছড়ায় হাকালুকি। বর্ষায় থাকে ভরা যৌবন।

সাগরসম জলরাশিতে নাও বেয়ে চলে মাঝিমাল্লা। স্বচ্ছ জলে বিমোহিত হয়ে সাঁতার কাটেন পর্যটকরা। আর শুষ্ক মৌসুমে অন্য সৌন্দর্য ফুটে ওঠে হাকালুকির। এখন হাওরের বুকে কেবল সবুজ প্রান্তর। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই কেবল সবুজের সমারোহ। ফলে হাকালুকির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে শুষ্ক মৌসুমেও ভিড় করেন পর্যটকরা।
 
সিলেটের রাতারগুল ছাড়াও বৃহৎ সোয়াম্প ফরেস্ট অবস্থিত হাকালিুকতে। পর্যটকরা এই মৌসুমে হাকালুকির বিস্তীর্ণ হিজল করচের সবুজ বাগান দেখতে ছুটে যান মাঝ হাওরে। পর্যটকদের অনেকে রাত্রি যাপন ক্যাম্প ফায়ার করে থাকেন। এ সময় মিঠাপানির মাছ দিয়ে অনেকে বারবিকিউ করেন বলে জানান হাওরপাড়ের বাসিন্দা ইউসুফ আলী।  
 
স্থানীয় বাসিন্দা আছমান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, বর্ষায় হাকালুকি সাগরে পরিণত হয়। আর এই মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের পরিযায়ী পাখির দেখা মিলে বিল বাদালে।
 
স্থানীয়ভাবে মিথ প্রচলিত রয়েছে- হাওর কইলে (বলতে) হাকালুকি আর যত কুয়া (কূপ)। হাওরের ৮০-৯০ শতাংশ তথা ২৩৮টি ছোট-বড় ও মাঝারি বিল রয়েছে। শীতকালে এসব বিলে কুদালী, দৈরল, লেইঞ্জাসহ বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির বিচরণে মুখর হয়ে ওঠে।    


 
সরেজমিন দেখা যায়, মিনি কক্সবাজার রূপ ধারণ করা হাকালুকির বুকে এখন চলছে বোরো ধান চাষ। চাষিরা ব্যস্ত ক্ষেত-খামার (বাতান) নিয়ে। আর হাকালুকির বিল বা কুয়াগুলো থেকে এই মৌসুমে মাছ আহরণ করে থাকেন ইজারাদাররা। সরকার থেকে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এসব জলমহাল কয়েক বছর পর পর ইজারা দেওয়া হয়। এসব বিলে মাছ ধরা দেখতেও দূর দূরান্ত থেকে ছুটে যান অনেকেই।  
 
তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হাকালুকির আয়তন ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর। তন্মধ্যে শুধু বিলের আয়তন ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর। এটি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় ৪০ শতাংশ, কুলাউড়া উপজেলায় ৩০ শতাংশ, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ১৫ শতাংশ, গোলাপগঞ্জ ১০ শতাংশ এবং বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৫ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত। হাকালুকিতে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি রয়েছে। তন্মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি, ৩০৫ প্রজাতির দেশিয় পাখি, ১৪১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ১০৭ প্রজাতির মাছ এবং ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ রয়েছে।
 
বাতান পদ্ধতি: শুষ্ক মৌসুমে হাকালুকির সবুজ প্রান্তরে অবাদে বিচরণ করে গরু, মহিষ, ছাগল ভেড়া। হাওর পারের লোকজন এই মৌসুমে নির্দিষ্ট কয়েক মাসের জন্য গবাদিপশু পাঠিয়ে দেন বাতানে। হাওরে গরু রেখে বিনিময়ে দুধ বিক্রি করে যাপিত জীবন ধারণকারীদের এই পদ্ধতিকে বাতান বলা হয়। বাতানের মালিকরা গবাদি পশুর দুধ ও দই থেকে বিপুল আয় করে থাকেন।
 
সবুজ পাহাড় বেষ্টিত স্বচ্ছ জলধারা বিছানাকান্দি, জলার বন রাতারগুল, প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্য ভরা জাফলং-লালাখাল আর সবুজ গালিচায় মোড়ানো চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগের আরেক অনুষঙ্গ হতে পারে ‘মিনি কক্সবাজার’ হাকালুকি হাওর।
 
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার তীরবর্তী ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্ট। হাকালুকির এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ অংশে অবস্থান করতে হয়। এই উপজেলার ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্ট থেকে উপভোগ করা যায় হাকালুকির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখান থেকে বিস্তীর্ণ হাকালুকি হাওরকে এক পলকে দেখা যায়। বর্ষার ন্যায় শীতেও হাকালুকির সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন।


                         
হাকালুকির অবস্থান: সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ছয় উপজেলা জুড়ে হাকালুকি হাওরের অবস্থান। প্রায় ১৮ হাজার ১শ’ ১৫ হেক্টর গড় আয়তনের মধ্যে ৩৮ ভাগ মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখায়, দুই ভাগ জুড়িতে, ৩০ ভাগ কুলাউড়ায়, ১৫ ভাগ ফেঞ্চুগঞ্জে, ১০ ভাগ গোলাপগঞ্জে ও ৫ ভাগ বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। উজানে ভারত থেকে নেমে আসা ৫টি পাহাড়ি নদী জুড়ি, কন্টিনালা, ফানাই, আন ফানাই ও বরুদল মিলেছে হাকালুকি হাওরে।
 
যাতায়াত: ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন ৩টি ট্রেন ছাড়ে সিলেটের উদ্দেশে। ট্রেনে সময় লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা। ট্রেনে গেলে রাত ৯টা ৫০ মিনিটের উপবন এক্সপ্রেসে যাওয়াই ভালো। সিলেটে পৌঁছার আগের স্টেশন মাইজগাঁও নেমে সেখান থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্ট। সিএনজি চালিত অটোরিকশায় ভাড়া নেবে একশ টাকা। এছাড়া বাসে যেতে চাইলে শ্যামলী, হানিফ, এনা, ইউনিক পরিবহন উল্লেখযোগ্য। ভোর থেকে শুরু করে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এসব বাস পাওয়া যায়। বাসে যেতে সময় লাগবে সাড়ে ৫ ঘণ্টা। সিলেট কোর্ট পয়েন্ট থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। যাত্রীবাহী বাসে ভাড়া নেয় ৩৫ টাকা, সিএনজি অটোরিকশায় ৩৫ টাকা। আর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা ১শ’ টাকা রিজার্ভ ভাড়ায় যেতে পারেন ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্টে। যেখানে হাকালুকি হাওরের পশ্চিম তীরের গন্তব্য।   
থাকবেন কোথায়: সিলেটে রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল, মোটেল, কটেজ। পর্যটকরা সারা দিন ঘুরে বিকেলে সিলেট সদরে পৌঁছে থাকতে পারেন পছন্দের যেকোনো জায়গায়।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২০
এনইউ/এমআরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।