সিলেট: নগরে ভাড়া বাসায় সস্ত্রীক থাকতেন আহমেদ সুলতান (ছদ্মনাম)। দাম্পত্য জীবনে তিনি এক সন্তানের জনক।
বেড়ানোর কথা বলে একদিন স্ত্রী রাহিমা বেগম (ছদ্মনাম) পিত্রালয়ে গিয়ে তালাকনামা পাঠান। তাতে উল্লেখ করেন, খোরপোষ দিতে না পারায় তালাক চান তিনি। কাবিনের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে স্ত্রী ইচ্ছে করলে তালাক দিতে পারেন, সে ক্ষমতাবলে স্বামীকে তালাক দেওয়ার অধিকার রাখেন।
সুন্দরমতো চলছিল রেহেনার (ছদ্মনাম) সংসার। কোলজুড়ে আসে তিন বছরের ফুটফুটে পুত্র সন্তান। স্ত্রী-সন্তানের প্রতি বেখেয়াল স্বামী। আস্তে আস্তে স্বামীর পরকীয়ার বিষয়টি আবিষ্কার করেন তিনি। অবিশ্বাসের সংসারে থাকতে চান না। পিত্রালয়ে গিয়ে ভরণপোষণ চেয়ে মামলা করলেও স্বামী গোপনে পাড়ি জমান প্রবাসে। তাই তালাক চেয়ে দ্বিতীয়বার আবেদন করেন তিনি।
সিলেটে ২০২০ সালে অনেকের সংসার ভেঙেছে এভাবে। করোনা যেমন কেড়ে নিয়েছে অনেক তাজা প্রাণ, তেমনি এই মহামারিও অনেকের সংসার জীবনে নিয়ে এসেছে বিষাদের ছায়া।
সিলেট সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, ৩৬৫ দিনে সিলেট মহানগরীতে গড়ে বিয়ে-বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে প্রতিদিন ৬টিরও বেশি। চলতি বছরের শুরু থেকেই বিয়ে-বিচ্ছেদের আবেদন আসতে থাকে সিলেট সিটি করপোরেশনে (সিসিক)। জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বরের পর্যন্ত সিসিকের কাছে জমা পড়েছে দুই হাজার ৩৭২টি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন। বেশির ভাগ আবেদন জমা পড়ে করোনাকালে। ২০১৮ সালে বিচ্ছেদ হয় ২৫৫টি। ২০১৯ সালে ২৯১টি। ২০২০ সালে সেটা ২ হাজার ছাড়িয়েছে।
দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর হওয়ার বদলে তিক্ততা সৃষ্টি হয়ে অনেক পরিবারে ফাটল ধরেছে। যার পরিণতি গড়িয়েছে বিচ্ছেদে। আবেদনকারীদের প্রায় ৬৫ শতাংশই নারী।
সিসিকের পরিসংখ্যান বলছে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিয়ে-বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছিলেন ২ হাজার ৩৩৬ জন। তারমধ্যে করোনাকালে ২ হাজার ১শটির বেশি আবেদন জমা পড়ে। শুধু ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ২শটি। প্রতিদিন গড়ে ৬টিরও উপরে এবং মাসিক গড় বিবেচনায় নিলেবিচ্ছেদের আবেদন প্রায় ১০ গুণ। শুধু নভেম্বর মাসে বিচ্ছেদের জন্যে আবেদন জমা হয় ২১টি। ডিসেম্বর মাসে ১৫টি আবেদন জমা হয়েছে।
সিসিক সূত্রে জানায়, বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বেশিরভাগ পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুক, মাদকসেবন করে নির্যাতন, প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগহীনতাই দায়ী।
এ বিষয়ে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, বিচ্ছেদের জন্য সিলেট সিটি করপোরেশনের আইন শাখায় প্রথমে আবেদন করতে হয়। আবেদন জমা করার পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপস তথা সমঝোতার জন্য প্রতি ৩০ দিন পরপর ৯০ দিনে ৩ দফায় নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর উভয়পক্ষকে নিয়ে শুনানিতে বসে সমাধানের চেষ্টা চালানো হয়।
তাতেও কাজ না হলে বিচ্ছেদ কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবছর ২৩টির উপরে বিচ্ছেদের আবেদন কার্যকর হয়েছে। করোনার সংক্রমণের কারণে গত মার্চের পর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুনানি বন্ধ ছিল। অক্টোবর মাসে দুই দিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্যে নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সমাজের অবক্ষয়ের ফলে এই পরিণতি। করোনাকালে দীর্ঘদিন মানুষ ঘরে বন্দি ছিলেন। এই সময়ে অনেকেই কর্ম হারিয়ে অর্থনৈতিক দীনতার কবলে পড়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ও মনোমালিন্য থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ইসলামে বিয়ে-বিচ্ছেদকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হালাল বলা হয়েছে। তাই একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের ধর্মের বিষয়টি প্রধান্য দেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এটিএম ফয়েজ বলেন, সামাজিক অস্থিরতা, আর্থিক অনটনের কারণে দিন দিন বিয়ে-বিচ্ছেদ বাড়ছে। তবে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট অনেকটা ভালো অবস্থায় রয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রত্যেকের উচিত নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে বিষয়গুলো পারিবারিকভাবে মীমাংসা করে নেওয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
এনইউ/এএ