ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘সবাই এহন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতাছে, আমিও চাই’

জাকিয়া আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১০
‘সবাই এহন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতাছে, আমিও চাই’

শেরপুর: ‘ছেলে-মেয়েরা আমার কাজের জইন্য খুবই লজ্জিত। তারা বলে- তুমি মইরা যাইতা, বদর বাহিনীতে গেলা ক্যান? আমি নিজেই কই আমি যুদ্ধাপরাধী।

আমার কাজের জইন্য আমি লজ্জিত। ’

এ কথাগুলো একজন মোহন মুন্সির, যিনি শেরপুর জেলার রঘুনাথপুর বাজারের শ্রী শ্রী দক্ষিণা কালিমাতা মন্দিরে   মোহাম্মাদ কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে বাঙালিদের ওপর চালানো বর্বরতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাাৎকারে তিনি বললেন, ‘সবাই এহন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতাছে, আমিও চাই। এই লোক যদি যুদ্ধাপরাধীর মামলা তাইকা রেহাই পায়া যায় তা অইলে আপনাগোর স্বাধীনতা যুদ্ধ মিথ্যা অইয়া যাইবে। ’

১৯৭১ সালে মোহন মুন্সির বয়স ছিল ২০ কী ২১। দর্জিদোকানে কাজ করতেন তিনি। দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেও কেউ কেউ চাকরির প্রলোভন পেয়ে ছিলেন বিপক্ষে। মোহন মুন্সির দাবি- তিনিও তাদেরই একজন।

তার ভাষায়, ‘রেসকোর্স ময়দানে শেখ সা’বের ভাষণের পর শেরপুর কাকলি সিনেমা হলের সামনে মাইক বাজাইয়া ঘোষণা  দেয়, স্বেচ্ছাসেবক দলের ট্রেনিং দেওয়া অইবো। যারা ট্রেনিংয়ে অংশ নিবে তারা চাকরি পাইবে আনসারে। তহন আমিসহ আরও বেশ কয়জন ট্রেনিংয়ে অংশ নেই। কিন্তুক শেরপুর বয়েজ কলেজে সেনারা ঘাঁটি গাড়লে যে যার মতো পলায়া যায়। ’

মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কামারুজ্জামানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরে মোহন মুন্সি আরও বলেন, ‘ট্রেনিংয়ে যোগ দিয়া  কামারুজ্জামানের বাড়ির সামনে আইলে আমারে  শেরপুর বয়েজ কলেজের ছাত্র রাজাসহ আরেকজন ৫০০ টেকা দিয়া কয় যা আল বদর বাহিনীতে ভর্তি অইয়া যা। না অইলে পাক বাহিনী আমারারে মাইরা লাইবো। তহন এইহানে আর্মির হেড ছিলেন মেজর রিয়াজ। এরপর আমি বদর বাহিনীতে ভর্তি হই। আমরারে দেওয়া অয় ট্রেনিং। বদর বাহিনীর প্রধান ছিল কামারুজ্জামান। তখন হে পড়তো জামালপুর আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজের প্রথমবর্ষে। তার সহযোগী ছিলো কামরান, কামাল, মাহমুদ, নাছিরসহ আরও কয়েকজন। ’

তিনি জানান, ট্রেনিংয়ের পর বদর বাহিনীর সদস্যদের কামারুজ্জামানের টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

মোহন মুন্সির ভাষায়, ‘বদর বাহিনীর ক্যাম্প থাইকা বাইর অওনের পর ভিতরে ঢুকা খুব কঠিন ব্যাপার আছিল। এইজন্য আমরা কিছু সংকেত ব্যবহার করতাম। যাতে আমরা নিজেরারে চিনতে পারি। ভেতরে ঢুকার সময় আমরা বলতাম  ‘কৈতর’ (কবুতর)। আর ভিতরে থাইকা বলা অইতো ‘বুলবুল’। এভাবেই আমরা কাজ করতাম। ’

সেদিন বদর বাহিনীতে ৬০/৭০ জন একসঙ্গে যোগ দেয় বলেও জানান তিনি।

বদর বাহিনীতে তার দায়িত্ব কী ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে মোহন মুন্সি বলেন, ‘আমি পাহারাদারের কাজ করতাম। পাক হানাদার বাহিনী রাজাকার, আল বদর ও আল শামসরা আওয়ামী লীগকর্মী, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ও যারা জয়বাংলা সোলোগান (স্লোগান) দিতো তাগোরে কামারুজ্জামানের টর্চারিং সেলে ধইরা লইয়া আইতো। আমি তাগোরে পাহারা দিতাম। ’

মূলত নখনা, পিয়ারপুর, বাইন্যারচর, ঝগড়ারচরসহ আরও কয়েকটি এলাকার মানুষকে এ টর্চার সেলে ধরে নিয়ে আসা হতো বলে জানান তিনি।

মোহন মুন্সি আরও জানান, সে সময় কামারুজ্জামানের কথায়ই চলতো ওই এলাকার পুলিশ প্রশাসন, কামারুজ্জামান যা কইতো শেরপুরে সেইটাই ছিল আইন। পুলিশ বাহিনীও তার কথা মতো চলতো। থানায় গিয়া হে যা কইতো সেইটাই করা অইতো। বিবিন্ন (বিভিন্ন) এলাকা থাইকা ধইরা আনা যুবক-পোলাগোরে এই সিঁড়িঘরের নিচে মাইরধর করা অইতো। বাড়ির ভিতর থাইকা  ঘাটঅলা পুকুরের পানিত তাগোর চুলে ধইরা চুবানো অইতো। তাগোরে বলা অইতো যতক্ষণ সম্ভব সাঁতরা। না অইলে গুলি করা হইবো। ’

এসব কাজে কামারুজ্জামানের সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন, মাহমুদ, নাছির, কামাল।

কোনো নারীকে ধরে আনা হতো কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে মোহন মুন্সি বলেন, ‘ধইরা আনা যুবক-পোলাগোরে মা-বইন-স্ত্রীরা ছাড়ায়া নিতে আইলে তাগোরেও টর্চার করা অইতো। ধইরা আনা সবাইরে খুন করা অইছে। অন্তত ২/৩ শ’ লোকেরে ধইরা আইন্যা চোখ বাইন্ধা খুন করা অইছে। ’

‘কামারুজ্জামানের নির্দেশে যেমন খুন করা হতো, আবার পুকুর পাড়ে দাঁড় করিয়ে নিজ হাতেও তিনি অনেক হিন্দুকে খুন করেছেন। মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় ছিল কামারুজ্জামানের অফিস। ’

মোহন মুন্সি একটা দুটো নয়, ৫টি বিয়ে করেছেন।

তার ভাষায় ‘একটি মরলে আরেকটারে  করছি। এহন আমার ঘরে দুই স্ত্রী । ’

মোহন মুন্সি ২ মেয়ে ও তিন ছেলের জনক।

ছেলে-মেয়েরা আপনার একাত্তরের কর্মকাণ্ডকে কীভাবে মূল্যায়ন করে- এ প্রশ্নের জবাবে দুই হাত জড়ো করে মোহন মুন্সি বলেন, ‘ছেলে-মেয়েরা আমার কাজের জইন্য খুবই লজ্জিত। তারা বলে- তুমি মইরা যাইতা, বদর বাহিনীতে গেলা ক্যান? আমিও একজন যুদ্ধাপরাধী। আমি আমার কাজের জইন্য লজ্জিত। তবে আমি নিজে কোনো খুন খারাপি করি নাই। কামারুজ্জামানের খুন করা দেখছি। সে আমারে খুব বিশ্বাস করত। তার সব কুকর্মের সাক্ষী আমি। তারপর বিচারে আমার যা শাস্তি অইব আমি মাথা পাইত্যা নিবাম। সবাই এখন বিচার চাইতাছে আমিও চাই। ’

এই প্রতিবেদকের কাছে স্বঘোষিত এই যুদ্ধাপরাধীর উল্টো প্রশ্ন- ‘আমি বদর হইয়া ঠেকছি, আবার সাক্ষী অইয়াও ঠেকছি। এহন আমারে আর আমার ফ্যামিলিরে কে নিরাপত্তা দিবো?’

তার কাছে আবারো জানতে চাওয়া হয় শেরপুরে হত্যাযজ্ঞের মূল হোতা কে ছিল?

এ প্রশ্নের জবাব দিতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি মোহন মুন্সি। এক বাক্যে বললেন, ‘কামারুজ্জামানই ছিল শেরপুরের সব কুকর্মের হোতা। আমি সবার সামনে খাড়ায়া এই কথা কইতাম পারবাম। আমি হের (কামারুজ্জামানের) সব কুকর্মের সাক্ষী। এই লোক যদি যুদ্ধাপরাধীর মামলা থাইক্যা রেহাই পায়া যায়, তা অইলে ত আপনাগোর স্বাধীনতা যুদ্ধ মিথ্যা অইয়া যাইবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।