কালোবাজারি আর চোরাচালানের পাশাপাশি ভ্যাট ফাঁকিতেও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ইউএস বাংলা গ্রুপের ১২ অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এ তথ্য দিয়ে কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আত্মসাৎ করে মাত্র কয়েক বছরে ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’ হয়েছে ইউএস বাংলা গ্রুপ।
ইউএস বাংলা গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের একটির বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালান ও আরেকটির বিরুদ্ধে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার অপব্যবহার এবং অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে। এ অবস্থায় ইউএস বাংলা গ্রুপের ১২ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ফাঁকি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভ্যাট বিভাগ সূত্র। এ প্রসঙ্গে জাতাীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইটি) ড. আবদুল মান্নান শিকদার বলেন, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন চলমান প্রক্রিয়া। এ জন্য অডিট করা হয়। মাঠ পর্যায়ে ভ্যাট গোয়েন্দাও কাজ করছে।
জানা গেছে, মাত্র এক দশক আগে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউএস বাংলা গ্রুপের এখন ১২টির বেশি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো- ইউএস বাংলা অ্যাসেটস্, ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস, ইউএস বাংলা মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ইউএসবি এক্সপ্রেস, ইউএস বাংলা লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউএস বাংলা ফুটওয়্যার, ইউএস বাংলা হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউএস বাংলা অটোমোবাইলস্, ইউএস বাংলা ফুডস্, ইউএস বাংলা ফ্যাশনসসহ আরও নানাবিধ প্রতিষ্ঠান। সময়ের হিসাবে ইউএস বাংলা গ্রুপের ব্যবসার পরিধি রহস্যজনকভাবে বেড়েছে, যা বাংলাদেশে অনেকটাই বিরল।
ভ্যাট প্রশাসন সূত্র জানায়, ইউএস বাংলা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউএস বাংলা অ্যাসেটস লিমিটেড ঢাকার অতিসন্নিকটে পূর্বাচলে যে ‘পূর্বাচল আমেরিকান সিটি’ প্রকল্প রয়েছে, তাতে ভ্যাট ফাঁকি চলছে ফ্রিস্টাইলে। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউএস বাংলা অ্যাসেটস লিমিটেডের অন্য দুই আবাসন প্রকল্প হলো- ইস্ট আমেরিকান সিটি ও হলিডে হোমস কুয়াকাটা। এ তিন আবাসন প্রকল্পের ভ্যাট ফাঁকি দীর্ঘদিন যাবৎ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
ইউএস বাংলা গ্রুপের কুরিয়ার সেবা প্রতিষ্ঠান ইউএসবি এক্সপ্রেস লিমিটেডের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই ভ্যাট প্রশাসনে। প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট চালান ছাড়া পণ্য পরিবহন করে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যাট চালান ছাড়া পণ্য পরিবহন করায় ইউএসবি এক্সপ্রেসকে জরিমানা করা হয় বলে তখন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ঢাকা পশ্চিম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের তৎকালীন কমিশনার ড. মইনুল খান। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রাপ্য ভ্যাটও আদায় করা হয় বলে তথ্য দিয়েছেন।
ইউএস বাংলা গ্রুপের জুতা ও চামড়াজাত তিন প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকিও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ইউএস বাংলা লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেডের নামে থাকা বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা আমদানি পণ্য কালোবাজারিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। ইউএস বাংলা ফুটওয়্যার লিমিটেড ও ভাইব্রেন্ট ফুটওয়্যার লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান দুটির উৎপাদন ও বিক্রির বিপরীতে সরকার প্রাপ্য ভ্যাট থেকে বঞ্চিত। শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত ইউএস বাংলা লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানির বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার আড়ালে কালোবাজারিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্র জানায়, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভয়াবহ অনিয়মে জড়িত ইউএস বাংলা লেদার। প্রতিষ্ঠানটির বছরের পর বছর রপ্তানি নেই। তবু বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানি করছে। কালোবাজারিতে জড়িত থাকার অপরাধে ইউএস বাংলা লেদারকে এরই মধ্যে জরিমানা করা হয়েছে। ইউএস বাংলা লেদারের শুল্ক ফাঁকি উদঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ইউএস বাংলা গ্রুপের দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং ইউএস বাংলা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়ছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান দুটি থেকে প্রাপ্য ভ্যাট থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। ২০০৩ সালে যাত্রা করা গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে বর্তমানে ৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়ছেন।
ইউএস বাংলা গ্রুপের আরেক বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান বেসরকারি উড়োজাহাজ সেবাদানকারী ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস লিমিটেড। ১৭ জুলাই ২০১৪, সালে যাত্রার পর প্রতি বছর বিক্রি হওয়া লাখ লাখ টিকিটের বিপরীতে আদায় হওয়া প্রাপ্য ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি বলে মনে করেন ভ্যাট প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য, প্রভাবশালী এ প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির নিরপেক্ষ তদন্ত হলে সরকার কয়েক শ কোটি টাকা রাজস্ব পাবে।
জানা গেছে, ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে জড়িত ইউএস বাংলা হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ সঠিক প্রক্রিয়ায় ভ্যাটের রিটার্ন দাখিল না করে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এ ছাড়া কোটি কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে ফ্রিস্টাইলে ব্যবসা পরিচালনা করছে ইউএস বাংলা মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন, ইউএস বাংলা ফুড, ইউএস বাংলা ভেভারেজ অ্যান্ড এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইউএস বাংলা রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ও ইউএস বাংলা এগ্রো লিমিটেড।
সৌজন্য: বাংলাদেশ প্রতিদিন