ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আদালত চত্বরের ঝাড়ুদার হলেও স্বপ্ন দেখে জজ হওয়ার!

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১
আদালত চত্বরের ঝাড়ুদার হলেও স্বপ্ন দেখে জজ হওয়ার!

ফেনী: কামাল হোসেন রহমান। ফেনী শহরতলীর শহীদ মেজর সালাহ উদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী।

এ পরিচয় রহমানের ছাত্রত্বের। বিপরীত পরিচয় সে ফেনী জজ কোর্ট এলাকার ঝাড়ুদার। এ কাজ করেই সে সংসার চালিয়ে পড়ালেখার খরচ চালায়।

মানুষের দৃষ্টিতে নিচু পেশায় কাজ করলেও রহমানের স্বপ্নের পরিসর বিস্তর। যে আদালত চত্বরে সে ঝাড়ু দেয়, মা বিচারকদের ভাত রান্না করে-সেই আদালতেরই বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন এই কিশোর। এমন স্বপ্ন দেখা তার কাছে কখোনোই ধৃষ্টতা মনে হয়নি। স্বপ্নবাজ এ কিশোরের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। স্বল্প-দৈর্ঘ আলোচনায় উঠে আসে তার সংগ্রাম ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছুটে চলার গল্প।  

রহমান বাংলানিউজকে জানায়, তার বাবা জামাল উদ্দিন এক যুগেরও বেশি সময় আগে তাদের তিন ভাই-বোন ও মাকে ছেড়ে চলে যান। নোয়াখালীতে থাকেন তার বাবা। সেখানে আরেকটি সংসারও পেতেছেন। খোঁজ নেন না রহমানদের। মা জোহরা বেগম শহরের বিভিন্ন মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেন। মায়ের যা আয় হয় তা দিয়ে এক বোন ও তিন ভাইসহ পাঁচজনের সংসারও ঠিক মতো চলে না।

উপায় না দেখেই ৯ বছর বয়স থেকে সে কাজে নেমেছে। কিন্তু পড়ালেখা সে ছাড়েনি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকাকালীন আদালত চত্বরের একটি চা দোকানে চাকরি করতো- তখন সারাদিনে আয় ছিলো ৩০ টাকা। সেই থেকে রহমানের কর্মজীবন শুরু, সাথে চলতে থাকে পড়াশোনাও।  রহমানরা থাকে শহরের পুলিশ লাইন এলাকার একটি টিনশেড ঘরে। তার বাকি দুই ভাই সুজন (১৬) ও আরমান (১৩) পড়াশুনো করে। তাদের কাজ করতে হয় না। আরমান নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে ছোট ভাইগুলোকে পড়াশোনো করানোর। বোন নার্গিসের (২১) বিয়ে হয়েছে। বোনের প্রতি পুরো দায়িত্বটাও পালন করে রহমান।

রহমান জানায়, করোনাকাল হওয়ায় এখন স্কুলবন্ধ। এজন্য সকালে উঠে শহরের মৎস্য আড়তে গিয়ে মাছের টুকরি বহনের কাজ করি। সকাল ৮টা সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সেখানে কাজ করি। সেখানে কোনো দিন আয় ১০০ কোনো দিন ২০০ টাকা আয় হয়। এরপর ঘরে ফিরে পড়তে বসি। ৯টায় স্কুলে গিয়ে ফিরতে বিকেল গড়ায়। দুপুরের খাবার খেয়ে চলে যায় ফেনী জজ কোর্ট চত্বরে। বিকেল ৫টা থেকে শুরু হয় কাজ। পুরো অঙ্গন ঝাড়ু দেওয়া ও ময়লাগুলোকে এক সথে করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে সময় লেগে যায় ঘণ্টা দুয়েক। সেখান থেকে ফিরে বসে পড়ার টেবিলে।

রহমান বাংলানিউজকে জানায়, আদালত চত্বরে ঝাড়ু দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বেতন পাইনা। সেখানকার সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং আইনজীবী সহকারীদের থেকে মাস শেষে চাঁদা উঠিয়ে তার পারিশ্রমিক দেয়। কোনো মাসে এক হাজার আবার কোনো মাসে দেড় হাজার টাকা আয় হয় ঝাড়ু দেওয়ার এ কাজ করে। এছাড়াও আদালতের আইনজীবী ও বিচারকরাও  মাঝে মধ্যে আর্থিক সহায়তা করেন।

আজগর হোসেন নামের এক আইনজীবী সহকারী বাংলানিউজকে বলেন, ছেলেটা অনেক ভদ্র এবং মেধাবী। পরিবার চালাতে সে ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করে।

এক চা দোকানি বাংলানিউজকে বলেন, রহমান তাদের দোকান ও আশপাশের এলাকায় ঝাড়ু দিয়ে আসছে অনেক বছর ধরে। তার আচার আচরণে ফুটে ওঠে তার শিক্ষা ও নম্রতা ভদ্রতা। দুলাল তালুকদার নামের স্থানীয় এক ফটো সাংবাদিক জানান, গত কয়েক বছর আগে রহমানের সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর থেকে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা এনে তিনি রহমানকে দিচ্ছেন।

রহমানের মা বিবি জোহরা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, স্বামী তাদের ছেড়ে যায় ১৪ বছর আগে। স্বামীর বাড়ি পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের কাশিমপুর গেলে সেখানেও মাথা গোজার ঠাঁই হয়নি। ছোট ভাই-বোনগুলাকে পড়ালেখা ও সংসারের খরচ চালানোর জন্য তার সঙ্গে সমান তালে খেটে যাচ্ছে বড় ছেলে রহমান।  

রহমান জানায়, নিদারুণ কষ্টে কাটে তাদের পাঁচ জনের পরিবার। ছোট ভাইগুলোর পড়াশোনা বোনের দেখভালসহ যাবতীয় খরচ তাদের দুই জনের সামান্য আয়ে কুলিয়ে ওঠেনা। করুণা নয় স্বপ্ন বাস্তবায়নে কেউ যদি তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেন তাহলে তা সে সানন্দে গ্রহণ করবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১
এসএইচডি/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।