ঢাকা, শুক্রবার, ৯ মাঘ ১৪৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বাগেরহাটে পুরুষ শূন্য শতাধিক পরিবার, আতঙ্কে নারী-শিশুরা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২১
বাগেরহাটে পুরুষ শূন্য শতাধিক পরিবার, আতঙ্কে নারী-শিশুরা

বাগেরহাট: বাগেরহাটের মোল্লাহাটে হামলা ও গ্রেফতার এড়াতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন শতাধিক পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। পুরুষদের পাশাপাশি জীবন ও সম্মান বাঁচাতে নারী-শিশুরাও এক ধরনের পলাতক জীবন-যাপন করছে।

আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না তারা। কেউ কেউ আবার এলাকা ছেড়ে আত্মীয়দের বাড়িতে অবস্থান করছেন।  

প্রতিপক্ষের হুমকি-ধামকিতে পুরুষ শূন্য পরিবারগুলোর মাঠের ফসলও ঘরে তুলতে পারছেন না। ফসল পরিচর্যার জন্য শ্রমিকও যেতে পারছে না মাঠে। গত ০১ এপ্রিল মোল্লাহাট উপজেলার চুনখোলা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী মামুন শেখ ও কিবরিয়া শরীফের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মামুন শেখের চাচা শাসন গ্রামের আসাদ শেখ নিহতের জেরে মামুন শেখের সমর্থকদের তাণ্ডবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে শাসন গ্রামে।

ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, নিহতের পরে মামুন শেখের সমর্থকরা এলাকার শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর করে। মামুনের সমর্থকদের হামলা থেকে বাঁচতে অন্তত শতাধিক লোক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে শনিবার (০৩ এপ্রিল) নিহত আসাদ শেখের মেয়ে মমতাজ বেগম বাদী হয়ে ৮৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে মোল্লাহাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীকালে মামলাটি বাগেরহাট জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।  

মামলায় এজাহার নামীয় আসামি সাবেক ইউপি সদস্য মিকাইল হোসেন চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও রক্ষা পায়নি মিকাইল চৌধুরীর বসবাস করা ভবন। ইউপি সদস্য প্রার্থী মামুন শেখের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক লোক হামালা দিয়ে মিকাইলের ভবন ভেঙে ফেলে। ভাঙচুর ও লুটপাট করে ভবনের মধ্যেও। ভেঙে ফেলে ফ্রিজ, টেলিভিশন, খাটসহ মূল্যবান সামগ্রী। ভয়ে পালিয়ে গেছে মিকাইলের স্ত্রী সন্তান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শুধু মিকাইল চৌধুরীর বাড়ি নয়, শাসন গ্রামের সালাউদ্দিন চৌধুরী, এনামুল হোক চৌধুরী, একরামুল হোক চৌধুরী, কিবরিয়া শরিফ, ইউসুফ চৌধুরী, রফিক চৌধুরী, নাজমুল চৌধুরী, গাউস চৌধুরী, আমানত চৌধুরী, কালাম চৌধুরী, আবুল হোসেন চৌধুরী, এনামুল হোক চৌধুরী, লায়েব চৌধুরী, হানিফ চৌধুরী, কারিম চৌধুরী, আসাদ আলী সেখ, রজ্জব আলী সেখ, মিজান আলী সেখ, আশরাফ আলী সেখ, সাখাওয়াত ভূঁইয়া, মওলা সরদার, মর্তুজা সরদার, আইয়ুব আলী শিকদার, উজ্জল শিকদার, বাবু মোল্লা, আবেদ আলী ভূঁইয়া, ওবায়দুল ভূঁইয়া, হাসান ভূঁইয়া, বাচ্চু ফকির, শরিফুল ফকির, হাসান শরিফ, হুমায়ুন শেখ, ছবেদ মোল্লা, মুনসুর শরিফ, পলাশ শেখ, এশারত শেখসহ শতাধিক মানুষের বাড়িঘর ভাঙচুর করেছেন ইউপি সদস্য প্রার্থী মামুন শেখের সমর্থকরা। পুরুষদের না পেয়ে ভাঙচুরের সময় মারধরও করেছেন নারীদের। পুরুষ শূন্য পরিবারগুলোর নারীরাও রয়েছেন আতঙ্কে।

মিকাইল চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রওশন বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আসাদ শেখ যে রাতে মারা যায়, ওই রাতেই তার ভাইপো মামুনের লোকজন এসে আমাদের অনেকের বাড়িঘর ভাঙচুর করে। তালা ভেঙে ঘরের মধ্যে থাকা মালামাল লুট করে নেয়, যা নিতে পারেনা সেসব ভাঙচুর করে রেখে যায়। পরবর্তী তিন দিন এসে আমার ভাসুরের এই ভবন ভেঙে দিয়ে গেছে তারা। আশপাশের যাকে সামনে পেয়েছে তাকে মারধর করেছে। নারীদেরও বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করতে দেয়নি।

মাহফুজা বেগম, হালিমা বেগমসহ আরও কয়েকজন বলেন, যেভাবে বাড়িঘর ভেঙেছে তাতে বসবাস করার কোনো অবস্থা নেই। ঘরের মধ্যে থাকা মূল্যবান মালামাল লুট করেছেন, যা নিতে পারেননি সেসব ভাঙচুর করেছে। ঘরের চালও কুপিয়েছে। ঘরের মধ্যের লেপ, তোশক, বালিশ ও কাপড় চোপড়েও আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তারা। রান্নাঘরের হাড়ি-পাতিলসহ সব কিছু ভাঙচুর করেছে তারা। স্বামী-ছেলে সবইতো পলাতক আছে। কি করব কিভাবে বাঁচবো জানি না।

পলাতক দিনমজুর নাসির মোল্লার স্ত্রী বেবি বেগম বাংলানিউজকে বলেন, হত্যার পর থেকে আমার স্বামী পলাতক রয়েছে। মাঠে কিছু ধান রয়েছে, তাতেও পানি দিতে পারছি না। বাড়ি এসে বলে গেছে পানি দিয়ে হবে কি ধান তো আমরা নিয়ে যাব। শুধু বেবি বেগম নয় আরও কয়েকজন এ ধরনের অভিযোগ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বৃদ্ধ বলেন, দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার আসামি গ্রেফতার হবে, আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু এলাকার মানুষের ওপর অত্যাচার, বাড়িঘর ভাঙচুর, আগুন দেওয়া, নারীদের গায় হাত দেওয়া কোনো সভ্যতা হতে পারে না। আমরা নীরহ মানুষ হিসেবে এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা চাই।

এদিকে, আসাদ শেখ হত্যা মামলায় চুনখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুন্সি তানজিল হোসেনকে আসামি ও ভাঙচুর করায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। তবে প্রাণ ও সম্পদ হারানোর ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ স্থানীয়রা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছু মোল্লাহাট উপজেলা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, মুন্সী তানজিল হোসেনের সৎ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তানজিল ভাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি এলাকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তাকে আসামি দেওয়া হয়েছে। সঠিক তদন্তপূর্বক এই মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

এ বিষয়ে ইউপি সদস্য মামুন শেখ বাংলানিউজকে বলেন, আমার কোনো লোক কারও বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করেনি। হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে না থাকলে ধানে পানি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।  

শতাধিক বাড়িঘর ভাংচুরের ছবি রয়েছে এগুলো কে করেছে এমন প্রশ্নে মামুন বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরে কয়েকটি বসত বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। তবে তা কে বা কারা ভেঙেছে তা আমি জানি না।

মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী গোলাম কবির বাংলানিউজকে বলেন, এলাকা এখন শান্ত রয়েছে। যেযার প্রয়োজনীয় কাজ করছেন। প্রতিদিন পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ হত্যা মামলাটি গ্রহণ করায় তারা তদন্ত করছেন।

তিনি আরও বলেন, ভাঙচুরের ঘটনায় হানিফের স্ত্রী হাফিজা বেগম ২৩ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। ওই মামলাটিও আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।