পাবনা (ঈশ্বরদী): গত একশ বছরের বেশি সময় ধরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-মিরপুর রেলওয়ে সেকশনের গার্ডার ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন চলাচল করেছে। ব্রিটিশ আমলের ইটের মধ্যে চুন-সুড়কির গাঁথুনির শক্তি নষ্ট হয়ে ছাইয়ের মত হয়ে যাওয়ায় রেললাইন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী দফতরের প্রকৌশলী বিভাগ ৫৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ১০ ফুট আকৃতির ১৯৯ নাম্বার গার্ডার ব্রিজটি পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।
মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ধুপইল ইউনিয়নে (খুলনা-ঈশ্বরদী) রেলরুটের (বন্ধ হওয়া) গোয়ালবাথান স্টেশনের অদূরে গার্ডার সরিয়ে সিসিক্রিপ আর এস জয়েন্ট দিয়ে অস্থায়ী ব্যবস্থাপনাতে ট্রেন চলাচল করার জন্য রেললাইন উপযোগী করা হয়েছে। পরে ৩টার দিকে ঈশ্বরদী থেকে ছেড়ে যাওয়া মালবাহী ট্রেন অস্থায়ী ব্যবস্থাপনায় চালানো হয়।
এসময় পাকশী বিভাগের রেলওয়ে প্রকৌশলী, সহকারী রেলওয়ে প্রকৌশলী, ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলীসহ শতাধিক রেল-কর্মচারী ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
করোনাকালীন যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে চলাচল করছে মালবাহী, পার্সেল ট্রেন। খুলনা-ঈশ্বরদী রেলরুটে এই গার্ডার ব্রিজের উপর দিয়ে ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস, চিলাহাটিগামী রুপসা এক্সপ্রেস, সীমান্ত এক্সপ্রেস, রাজশাহীগামী সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস, কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস, গোপালগঞ্জগামী টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসসহ বেনাপোলগামী দুইজোড়া বেনাপোল এক্সপ্রেস, কলকাতাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেসসহ দুইজোড়া মেইল ও লোকাল ট্রেন চলাচল করে। এছাড়া মালগাড়ি তেলবাহী ট্যাঙ্কার ঝুঁকিতে চলাচল করতো।
শতবর্ষী গার্ডার ব্রিজ ভেঙে সংস্কার কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চুয়াডাঙ্গার সহকারী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আগে সব ট্রেন ব্রিজে আসার আগে থেমে যেত। ওপিটিতে ট্রেনের চালকের স্বাক্ষর করিয়ে ১০ কিলোমিটার গতিতে ঝুঁকি নিয়েই ৮ জোড়া আন্তঃনগর এবং মেইল-লোকাল ট্রেন পারাপার হতো। এছাড়া মালবাহী ট্রেন যাতায়াত করতো। এতে সময় লাগতো বেশি।
ব্রিটিশ আমলের পুরোনো ১৯৯ নাম্বার ব্রিজটিতে আরসিসি ফ্লোর করা হবে। গার্ডার ব্রিজের দুই পাশে এ্যাবার্টমেন্ট ওয়াল এবং ইটের গাঁথুনি হবে। তার ওপরে আরসিসি বেডব্লক হবে। বেডব্লকের পর রেললাইনের গার্ডার বসানো হবে। বর্তমানে এখন অস্থায়ী রেললাইন তৈরি করে মালবাহী ট্রেন চালানো হচ্ছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের প্রকৌশলী-১ বীরবল মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, পুরোনো এই সেতুর ওপর দিয়ে ধীরগতিতে ট্রেন চলাচলের সময় গতি কম থাকলেও কেঁপে উঠতো। পরে লক্ষ্য করা গেছে ব্রিটিশ আমলের পুরোনো রেলব্রিজে ইটের মাঝে চুন-সুড়কি দিয়ে গাঁথুনির শক্তি নষ্ট হয়ে ছাইয়ের মত হয়ে রেললাইন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। বেডব্লক ভেঙে গিয়ে ব্রিজে ফাটল দেখা দিয়েছিল।
পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী বীরবল মণ্ডল আরও জানান, ঈশ্বরদী-খুলনা রুটে ২৭০টি রেলব্রিজ আছে। সব ব্রিজগুলোই শত বছরের পুরোনো। আগামী এক বছরের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলো সংস্কার করা হলে ট্রেনের গতি বাড়িয়ে নিরাপদে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো চলাচল করানো সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, ঈশ্বরদী-খুলনা রেলরুটের ১৯৯ নাম্বার গার্ডার ব্রিজ চালু করা হয়েছিল ১৯০৮ সালে। ১০০ বছর আয়ুষ্কাল ধরা সেতুটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ২০০৮ সালেই। এরপর আরও ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল গার্ডার রেল ব্রিজটি।
জানা যায়, কুষ্টিয়ার গোয়ালবাথান নামে এক সময় রেলস্টেশন ও নদীবন্দর ছিল। মিরপুরের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। ৯০ এর পর তৎকালীন সরকার রেলওয়ে স্টেশনটি বন্ধ ঘোষণা করেন। ১৯১০ সালের দিকে তখন ট্রেন চলাচলের সুবিধার জন্য ব্রিটিশ শাসনামলে পদ্মা নদীর ওপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুর সময়ই গার্ডার রেল ব্রিজ নির্মিত হয়েছিল।
উল্লেখ্য, বাংলার প্রথম রেলপথ চালু হয় ১৮৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধনের মাধ্যমে। ১৮৭৪ সাল থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে নামে ব্রিটিশ সরকার একটি নতুন ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ রেললাইন স্থাপন করে। লাইনটি পদ্মার বাম তীর ঘেঁষে সারা (হার্ডিঞ্জ ব্রিজ) থেকে চিলাহাটি হয়ে হিমালয়ের পাদদেশস্থ ভারতের শিলিগুঁড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত।
কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ এবং আসামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের জন্য পদ্মার উপরে সেতু নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ে। তারই প্রেক্ষাপটে ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ দুই লেনবিশিষ্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেল চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হয়। ফলে উত্তরবঙ্গের শিলিগুঁড়ি থেকে চিলাহাটি হয়ে কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য স্থানে মালামাল সরবরাহ ও যাত্রী চলাচল গাড়ি বদল ছাড়াই সম্ভব হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২১
আরএ