ঢাকা: রাজধানীর দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম তার নিজ কক্ষেই পোশাক শ্রমিক আজাহারকে (৩০) হত্যা করেন। বাকবিতণ্ডার জেরে ক্ষিপ্ত হয়ে কোরবানির পশু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে আজাহারের গলার ডানপাশে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
রাতের অন্ধকারে কেউ টের পাওয়ার আগেই আজাহারের শরীরের খণ্ডিত ছয়টি অংশ ব্যাগে ভরে সরদার বাড়ি জামে মসজিদের নির্মাণাধীন সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর ওই কক্ষে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে। কক্ষের মেঝের রক্তমাখা কার্পেটটি তুলে নিয়ে ধুয়ে মসজিদের ছাদে ফেলে রাখেন এই ঘাতক। ঘটনাটি ঘটেছিলো গত ১৯ মে দিনগত রাতে।
ওইদিন থেকেই মঙ্গলবার (২৫ মে) ভোর পর্যন্ত এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ ছিলেন ভুক্তভোগী আজাহার। ঘটনার পর থেকে সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ওই শয়ন কক্ষে অবস্থান না করে ঘাতক মাওলানা আব্দুর রহমান পাশে থাকা মাদ্রাসাতুর রহমান আল আরাবিয়া নামে একটি মাদ্রাসায় দিন-রাত্রি যাপন করে আসছিলেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তবে ঘটনার এক সপ্তাহ পর মসজিদের ওই সেপটিক ট্যাংক থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। এছাড়াও সিঁড়িতে রক্তের দাগ দৃশ্যমান হয়। এমন তথ্যের ভিত্তিতে দক্ষিণখান এলাকায় ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-১ এর সদস্যরা। তদন্তে আজাহার নামে এক ব্যক্তি নিখোঁজ থাকার তথ্য পায় র্যাবের গোয়েন্দা দল। এরপর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওই মাদ্রাসা থেকে মসজিদের ইমাম ঘাতক আব্দুর রহমানকে গ্রেফতার করে র্যাব। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সরদার বাড়ি জামে মসজিদের নির্মাণাধীন সেপটিক ট্যাংক ভেঙে উদ্ধার করা হয় দক্ষিণখানের বাসিন্দা আজাহারের মরদেহের খণ্ডিত ছয়টি টুকরো। ঘাতক আব্দুর রহমানের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত তিনটি ছুরি ও একটি মোবাইলফোন জব্দ করা হয়।
র্যাব-পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানিয়রা জানায়, দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরেই দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদে ইমামতি করে আসছিলেন আব্দুর রহমান। এর আগে, দক্ষিণখানের সরদারপাড়ায় অবস্থিত মাদ্রাসাতুর রহমান আল আরাবিয়াতে শিক্ষক হিসাবে পড়াতেন।
দক্ষিণখানের সরদারপাড়ার মনির সরদারের বাড়িতে স্ত্রী আসমা বেগম (২৪) ও সন্তান আরিয়ানকে (৪) নিয়ে দীর্ঘ চার বছর ভাড়া ছিলেন। গত পাঁচ মাস হলো তারা বাসা পরিবর্তন করে দক্ষিণখানের মধুবাগ ২ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর বাসায় (মালিক- ইউসুফ কাজী) একটি ঘরে ভাড়া থাকেন।
আজাহারের ছেলে আরিয়ান প্রতিদিন সকালে মসজিদের মক্তবে পড়াশোনা করতো। ভুক্তভোগী আজাহার নিজেও ইমামের কাছে কোরআন শিক্ষা নিতেন। ধীরে ধীরে আজাহারের বাসায় প্রায় যাওয়া আসা করতেন আব্দুর রহমান। এতে আজাহারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। সম্পর্কের একপর্যায়ে আজাহারের স্ত্রীর সঙ্গে আব্দুর রহমানের যোগাযোগ বেড়ে যায়। আজাহার দাবি তুলেন তার স্ত্রীর প্রতি কুনজর দিয়েছেন আব্দুর রহমান।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছে, স্ত্রীর প্রতি কুনজর দেওয়ার দাবি জানিয়ে আজাহার গত ১৯ মে ডিউটি শেষে রাতে সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমামনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সেখানে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে কোরবানির পশু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে আজাহারের গলায় আঘাত করেন মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমান। মৃত্যুর পর লাশ গুম করতে ছয়টি খণ্ড করেন। পরে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেন। তবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত রয়েছে কি-না বা অন্য কোনো কারণ আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নিহত আজাহারের পাশের ঘরের বাসিন্দা শামসুন নাহার ইশা বাংলানিউজকে বলেন, গত পাঁচ মাস হলো তারা এই বাসায় ভাড়া এসেছে। কাজ শেষে রাতে আজাহার ভাই যখন বাসায় আসতেন, তখন তার স্ত্রী আসমা ইমাম সাহেবকে ফোন দিয়ে বলতেন, আমার স্বামী এসেছে, আপনি বাসায় আসেন। তখন মসজিদের ইমাম বাসায় আসতেন। আজাহার ভাই তার কাছে কোরআন শিক্ষা নিতেন।
তিনি বলেন, ঈদের আগের দিন (১৩ মে) তারা সবাই গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতি চলে যায়। এরপর গত ১৮ মে শুধু আজাহার ভাই এসেছিলেন। পরদিন ১৯ মে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেনি তিনি। একদিন না ফেরায় বিষয়টি তার স্ত্রীকে (আসমা বেগম) জানানো হয়েছিল। এরপর দু’দিন পর ২২ মে আসমা তার সন্তান ও বাবাকে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর তারা আবার টাঙ্গাইল চলে যান।
ঘটনাস্থলে যা দেখা যায়:
মঙ্গলবার (২৫ মে) দক্ষিণখানের সরদার পাড়ায় অবস্থিত সরদার বাড়ি জামে মসজিদটি তালাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। তিনতলা মসজিদের দ্বিতীয় তলায় উঠার সিঁড়ির বাম পাশে অবস্থিত মসজিদের ইমামের শয়ন কক্ষ। মসজিদের নিচ তলায় বা দিতে অজুখানা ও শৌচাগার। আর ওই অজুখানার নিচেই রয়েছে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক।
সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের অজুখানা ও শৌচাগার নির্মাণাধীন ছিল। তবে সেপটিক ট্যাংকের মুখ ভাঙা অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে। আর বাইরে থাকা কলাপসিবল গেটটি বন্ধ। অজুখানায় রক্তের দাগ দেখা গেছে। সেপটিক ট্যাংক থেকে প্রচুর দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। ট্যাংকে বর্জ্যের সঙ্গে রক্ত, টুকরো চামরা ও চর্বি ভাসতে দেখা গেছে। তবুও উৎসুক জনতার ভিড় করে দেখছিলেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য:
স্থানীয় বাসিন্দা ও দক্ষিণখান থানা শ্রমিকলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. এরশাদ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা শুনেছি, আজাহাররা আগে মসজিদের পাশেই সরদার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। আর তার ছেলে মসজিদের মক্তবে পড়ে। মসজিদের ইমামের কাছে আজাহারও কোরআন শিখতেন। ছেলেকে মসজিদ থেকে আনা নেওয়া করতেন আজাহারের স্ত্রী আসমা বেগম এতে প্রায় ইমামের সঙ্গে তার দেখা হতো। এছাড়াও ইমাম সাহেবের কাছ থেকে পানিপড়া নিতে আসতেন তিনি (আসমা বেগম)। তবে তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি-না তা জানি না।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, মসজিদের ইমামের সঙ্গে আজাহারের স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল। আর সেই সম্পর্ক আজাহারের ছেলে দেখে ফেলে এবং তাকে (আজাহার) বলে দেয়। পরে এই বিষয়টি জানতে দেখা করতে আসায় ইমাম সাহেব হয়তো আজাহারকে হত্যা করেছেন।
এদিকে দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তবে সেগুলো তদন্ত সাপেক্ষ। প্রাথমিক পর্যায়ের এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে:
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আব্দুল মোত্তাকিম বাংলানিউজকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হওয়া ইমাম আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, আজহার অভিযোগ করছিলেন, তার স্ত্রীর দিকে আব্দুর রহমানের কুনজর রয়েছে। কিন্তু আজহারের স্ত্রীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছেন আব্দুর রহমান। তবে হত্যাকাণ্ডে সে প্রতক্ষ্যভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এ ঘটনায় নিহত আজাহারের স্ত্রী আসমা বেগমের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়াও আরও কেউ জড়িত রয়েছে কি-না এ বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তরা বিভাগের দক্ষিণখান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইয়াসিন আরাফাত বাংলানিউজকে বলেন, ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিহত আজাহারের ছয় খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে। তবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আসামি মসজিদের ইমামকে র্যাব গ্রেফতার করেছে। সবদিক বিবেচনা করেই তদন্ত চলমান রয়েছে, আমরা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে ঘটনার আরও তথ্য জানতে পারবো।
** পরকীয়ার জেরে খুন করে লাশ সাত টুকরো
বাংলাদেশ সময়: ০২৩০ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০২১
এসজেএ/এসআরএস